মা চাইতেন মেয়ে বাংলা ভাষায় দক্ষতা প্রমাণ করে দেশসেরা বাংলাবিদ হোক। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতেই হবিগঞ্জের মেয়ে সামিরা মুকিত চৌধুরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এরপর সে ধাপে ধাপে বাংলা বানান, ব্যাকরণ ও সাহিত্য বিষয়ে নিজের দক্ষতা দেখিয়ে সেরা বাংলাবিদ নির্বাচিত হয়। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে ১০ লাখ টাকার মেধাবৃত্তি। এমন কৃতিত্বে সামিরার পরিবারের পাশাপাশি এলাকার মানুষও উচ্ছ্বসিত।
সামিরার বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার খনকারীপাড়া গ্রামে। সে স্থানীয় হোমল্যান্ড আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। বাবা মোহাম্মদ আবদুল মুকিত চৌধুরী ব্যবসায়ী এবং মা আছিয়া খাতুন ইয়াছমিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সামিরা বড়।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর বাংলাবিদ’ প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে চূড়ান্ত বিজয়ী হয় সামিরা মুকিত চৌধুরী। এবার পঞ্চমবারের মতো এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সারা দেশের দেড় লাখের বেশি প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়। এর মধ্যে চূড়ান্ত পর্বে সেরা ছয় প্রতিযোগী লড়াই করে। সেখান থেকে বিজয়ী বাছাই করেন বিচারকেরা।
গতকাল রোববার রাতে মুঠোফোনে কথা হয় সামিরার সঙ্গে। সে জানায়, তার মায়ের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল সে যেন বাংলাবিদ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তবে করোনা মহামারির সময় এ প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল। মহামারির পর প্রথম আয়োজনে সে অংশ নেয়। মফস্সলের মেয়ে হিসেবে সেরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগীদের সঙ্গে পারবে কি না, তা নিয়ে বিচলিত থাকলেও পরে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায়। এতেই সাফল্য পেয়েছে সে।
সামিরা বলে, ‘সব সময় শুদ্ধ বানান শেখার চেষ্টা করতাম। কখনো যেন বানান ভুল না হয়, সে জন্য সচেতন থাকতাম। তবে বাংলা বানান যেন শুদ্ধভাবে জানি, সে জন্য মা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বাবার অনুপ্রেরণাও ছিল। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমার জানার তীব্র আগ্রহ আছে। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ বিচিত্র বিষয়ের বই পড়ি। আর এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে।’
দেড় লাখ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম হওয়ার বিষয়ে সামিরা বলে, ‘কল্পনাও করিনি, আমি দেশসেরা হব। শুরুর দিকে খুব একটা ভালো না করলেও শেষের দিকে ভালো করি। আসলে কোন জায়গা থেকে আমি এসেছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূলত, আমি কী জানি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। নিজের মেধাকে যথাযথভাবে কাজে লাগালে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য আসবেই।’ এর সঙ্গে সে যোগ করে, ‘এটা ঠিক, আমি শুরু থেকে অনেক ভয়ে ছিলাম। দেশের ভালো ভালো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় ছিল। এর বিপরীতে আমি মফস্সলের একটা বিদ্যালয় থেকে এসেছি। তবে একটা পর্যায়ে নিজের মনোবল ফিরে পাই। বুঝতে পারি, আত্মবিশ্বাস থাকলে সাফল্য অর্জন করা খুব একটা কঠিন নয়।’
সামিরা মুকিত চৌধুরী এখন নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ বাংলা ভাষা, বানান ও সাহিত্যের চর্চা ছড়িয়ে দিতে একটা সংগঠন চালু করার পরিকল্পনার কথা জানায়। সে বলে, ‘আমার সাফল্যে নিশ্চয় অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। তারা যেন বাংলা সাহিত্যের ভালো ভালো বই পড়তে আগ্রহী হয়, সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করব। এ জন্য একটি সংগঠন কিংবা সংঘ গড়তে চাই। সেই সংগঠনের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
মেয়ের সাফল্যে খুশি সামিরার বাবা মোহাম্মদ আবদুল মুকিত চৌধুরী বলেন, ‘মেয়ে যেন ভবিষ্যতে দেশের জন্য মঙ্গলজনক কাজে যুক্ত থাকতে পারে, সেভাবেই গড়ে তুলতে চাই।’
সামিরার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবুল ফতেহ ফাত্তাহ সিলেটের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মদনমোহন কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবীগঞ্জ একটা প্রান্তিক অঞ্চল। এমন জায়গার একটা বিদ্যালয় থেকে রাজধানীতে গিয়ে মেয়েটি যে কৃতিত্ব অর্জন করেছে, এটা সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। এ সাফল্যে অন্য শিক্ষার্থীরাও উজ্জীবিত হয়েছে। তার দেখাদেখি নিশ্চয়ই এখন এখানকার অন্য শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা, বানান ও সাহিত্যচর্চায় মন দেবে।’