প্রত্যেক উপকারভোগীর ৩০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁদের ২৭–২৮ কেজি চাল দেওয়া হয়। আবার চালের দাম ১০০ টাকা বেশি নেওয়া হয়।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডিলাররা ওজনে চাল কম দিচ্ছেন এবং চালের দাম ৯০০ টাকা হলেও ১০০০ টাকা করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতারা। এ বিষয়ে কয়েকজন উপকারভোগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নওরীন হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ইউপি চেয়ারম্যান, ট্যাগ কর্মকর্তা ও খাদ্য কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করেছেন। কিন্তু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির উপকারভোগীরা বলছেন, কর্মকর্তারা এসেছেন কিন্তু তাঁরা টাকা ও চাল কিছুই ফেরত পাননি।
১৫ টাকা দরের চাল বিক্রি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ক্রেতাদের অভিযোগ ছিল, তাঁদেরকে মাপে চাল কম দিয়ে বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে। ১৮ আগস্ট থেকে উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে ৫১ জন ডিলার ২২ আগস্ট পর্যন্ত চাল বিক্রি করেছেন।
চরফ্যাশন উপজেলা খাদ্য বিভাগ জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে সরকার দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে কম মূল্যে চাল বিক্রির জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে খাদ্য অধিদপ্তর। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত বিধবা, বয়স্ক, পরিবারপ্রধান নারী, নিম্ন আয়ের দুস্থ পরিবারপ্রধানদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার জন্য একটি তালিকা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই কর্মসূচির চাল ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫ টাকা বাড়িয়ে কেজি ১৫ টাকা করা হয়েছে।
খাদ্য বিভাগ আরও জানায়, চরফ্যাশন উপজেলার ২৪ হাজার ৪১৩টি দুস্থ পরিবার কম দামে চাল কেনার সুযোগ পাচ্ছে। খাদ্য অধিদপ্তর নিয়োজিত ডিলাররা বিভিন্ন স্থানে চাল বিক্রি করবেন। ডিলাররা চাল কিনবেন ১৩ টাকা কেজি দরে। ১৫ টাকায় বিক্রির পরে লাভের ১০ শতাংশ ভ্যাট দেবেন।
চরফ্যাশন উপজেলার জিন্নাগড় ইউনিয়নের একাধিক দুস্থ পরিবারের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জিন্নাগড় ইউনিয়নে তিনজন ডিলার। প্রত্যেকে ৫০০ করে দেড় হাজার হতদরিদ্রের কাছে দুই মাসের (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ৬০ কেজি চাল অগ্রিম বিক্রি করেছেন। ১৮ আগস্ট ডিলার মো রুবেল ইউনিয়নের কাশেমগঞ্জ বাজারে ৫০০ জনের প্রতিজনকে ৬০ কেজির স্থলে ৫৪-৫৬ কেজি চাল দিয়েছেন। এ সময় তিনি ৬০ কেজির নির্ধারিত দাম ৯০০ টাকার স্থলে ১০০০ টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ডিলার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দুস্থ লোকজন আরও জানান, ২০ আগস্ট ইউনিয়নের কুতুবগঞ্জের ডিলার মো. জাহিদুল ইসলাম এবং দাসকান্দি এলাকায় ডিলার আ ফ ম আরিফ চাল বিক্রি করেছেন। ৬০ কেজির স্থলে ৫০-৫৬ কেজি চাল দিয়ে ৯০০ টাকার স্থলে ১০০০ টাকা করে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিলার জাহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁর অজান্তে কর্মচারী ৯০০ টাকার স্থলে ১০০০ টাকা নিয়েছেন। পরে চেয়ারম্যান বললে তিনি অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিয়েছেন।
চাল কম দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাহিদুল বলেন, প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমেই ৬০ কেজির স্থলে ৫৮ কেজি চাল দিয়েছেন। গুদাম থেকে কম দেওয়ায় ৩০ কেজির স্থলে ২৯ কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে।
দাসকান্দির ডিলার আ ফ ম আরিফ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সাংবাদিক ও অফিসাররা শুধু ডিলারের ভুল দেখেন, গুদামের অনিয়ম দেখেন না। গুদাম যে তাদের বস্তায় চাল কম দিচ্ছে, সেটা কেউ দেখে না।’
জিন্নাগড় ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সহিদুল হক, আবদুল বারেকসহ একাধিক ইউপি সদস্য জানান, ডিলার এক কেজি চাল ১৩ টাকা দরে কিনে ১৫ টাকার স্থলে ১৬ টাকা ১৬ পয়সায় বিক্রি করছেন। এরপরও ৩০ কেজিতে ৫-৬ কেজি চাল কম দিয়েছেন। দুই মাসে ৬০ কেজি চাল কাউকে দেননি। সবাইকে কম দিয়েছেন।
২২ আগস্ট পর্যন্ত উপজেলার প্রায় সব কটি ইউনিয়ন থেকে চাল কম দিয়ে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাল কম দিয়ে বেশি টাকা নেওয়ার কারণে অনেক ইউনিয়নে ডিলারদের সঙ্গে দুস্থ ব্যক্তিদের কথা–কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়েছে।
ক্রেতারা আরও জানান, চাল বিতরণের সময় একজন তদারক কর্মকর্তা উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বিক্রয়কেন্দ্রে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। দুস্থ ব্যক্তিরা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর মৌখিকভাবে ও মুঠোফোনে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
জিন্নাগড় ইউনিয়নের তদারক কর্মকর্তা চরফ্যাশন উপজেলা রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মো. মেসফা বলেন, তাঁকে চাল বিক্রির কথা জানানো হয়নি। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছেন।
উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়নে ডিলারকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াদুদ নিজেই (১৮-১৯ আগস্ট) তদারক কর্মকর্তার উপস্থিতি ছাড়াই চাল বিক্রি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও কম চাল দিয়ে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মুজিবনগরের ডিলার মো. রুবেল বলেন, ‘আমার ভাই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়নপত্র কেনার কারণে জোর করে তাঁর ডিলারশিপ বাতিল করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান। এখন চেয়ারম্যান নিজেই চাল বিক্রি করেছেন।’
মুজিবনগর ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াদুদ চাল কম দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।