শুকনা মৌসুমে পদ্মার বুক খুঁড়ে অবৈধভাবে মাটি ও বালু তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক শ ট্রাক ও ট্রলিতে করে সেই মাটি ও বালু শহরে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ট্রাক চলাচলের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে বানানো হয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ মাটির রাস্তা। কোনোরকম ইজারা ছাড়াই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় প্রায় এক মাস ধরে নদীর মাটি ও বালু লুটপাট চলছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা–কর্মীরা এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অবশ্য গত রোববার দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করার পর সন্ধ্যায় শ্রমিক ইউনিয়নের লোকজন সড়ক অবরোধ করে ভেড়ামারা শহর প্রায় অচল করে দেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভেড়ামারায় রাজনীতির মাঠে মহাজোটের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা–কর্মীদের মধ্যে বিরোধ সবচেয়ে বেশি। বিরোধে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু পদ্মা নদী থেকে মাটি ও বালু লুটপাটে কোনো বিরোধ নেই, এখানে তাঁরা একে অপরের সঙ্গী।
নেতারা মিলেমিশে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের সাতটি স্থান থেকে প্রতিদিন বালু ও মাটি তুলে বিক্রি করছেন। প্রতিদিন কয়েক শ ট্রাকে মাটি ও বালু তুলে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। সেই টাকা নেতা–কর্মীদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষিজমি থেকেও জোর করে মাটি কেটে নেওয়ার অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কুষ্টিয়া শাখার কর্মী মোহা. জাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মাটি, বালু দেদার খননের ফলে নদীর তলদেশে গভীর খতের সৃষ্টি হয়। সে কারণে বর্ষায় পলিমাটি এসে গর্তে পড়লে আশপাশের পাড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এতে নদীর গতিপথ বেঁকে যায়। সে কারণে এই অঞ্চলে প্রতি বছর ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। নদীর পানিপ্রবাহের একাধিক ধারা তৈরি হয়।
বালুমহালের বিষয়টি পুরোপুরি জেলা প্রশাসন দেখে—জানিয়ে কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে যদি বালু বা মাটি কাটা হয়, তবে সেটি অবশ্যই পরিবেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ও হুমকিস্বরূপ।
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভেড়ামারা উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন বাহিরচর, মোকারিমপুর ও বাহাদুরপুর ঘুরে মাটি, বালু উত্তোলন করে বিক্রির মহোৎসব দেখা গেল। পদ্মা নদী বেষ্টিত উপজেলার বাহিরচর ইউনিয়নের ১২ মাইল এলাকায় চারটি, মোকারিমপুর ইউনিয়নের বাগগাড়ি মাঠসহ দুটি, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা গ্রামে একটি স্থান থেকে বালু ও মাটি কেটে বিক্রি করতে দেখা গেছে। সাতটি স্থান থেকে প্রতিদিন কয়েক শ ট্রাকে মাটি ও বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ আনুমানিক ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বাহিরচর ইউনিয়নের ১২ মাইল পদ্মা নদী এলাকায় মাটি ও বালু উত্তোলনের ১৪ জনের একটি চক্র আছে। বাহিরচর ইউনিয়ন জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবু হোসেন ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহানুর রহমান, শফি মেম্বারসহ অন্যরা বালু তোলায় জড়িত বলে অভিযোগ আছে।
মোকারিমপুর ইউনিয়নের ফকিরাবাদে যুবলীগ নেতা কুতুব উদ্দিন ও সান্টুর নেতৃত্বে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। একই ইউনিয়নের বাগগাড়ি এলাকায় বালু তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউনিয়ন যুবজোটের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল হক ওরফে তুষার ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত। বাহিরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহেল রানা ওরফে পবন তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে রায়টা ঘাট এলাকায় ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর মেয়র শামীমুল ইসলাম ওরফে ছানা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠু, বর্তমান মেয়র ও উপজেলা যুবজোট সহসভাপতি আনোয়ারুল কবির ওরফে টুটুলের নামও উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘আমি অনেক কিছু জানি, তবে বলতে পারি না। আমি এসব কাজের সঙ্গে থাকি না, আমার নাম যদি কেউ বলে থাকে সেটি মিথ্যা বলেছে।’
আর পৌর মেয়র ও জাসদ নেতা আনোয়ারুল কবির বললেন, ‘আমার নাম বলবে কেন? আমি তো মেয়র। বালু উঠছে গ্রামে। তারপরও আমি প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে এসব বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি। কোনো চোর, বাটপার আমার নাম ভাঙিয়ে এসব করতে পারে। এর সঙ্গে আমার ও দলের কোনো নেতার সম্পর্ক নেই।’
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মোকারিমপুর ইউনিয়নের বাগগাড়ি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, তীর থেকে নদীর ভেতরে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঢুকে ট্রাকে বালু তুলে আনা হচ্ছে। ট্রাকসহ বালুবাহী যানবাহন চলাচলের জন্য শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকেই সড়ক বানানো হয়েছে। রোজ সেই সড়ক মেরামতের কাজ করেন ছয়জন শ্রমিক। দিনে জনপ্রতি ৫০০ টাকা পান তাঁরা।
নদীর তীরে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে পাহারা বসানো হয়েছে; করা হয়েছে থাকার জায়গা। একেকটি ট্রাক মাটি ও বালুতে ভরাট হওয়ার পরপর পাহারাদারদের হাতে টাকা গুঁজে চালক ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
বাগগাড়ি মাঠে যাওয়ার পরপর মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হন কয়েকজন ব্যক্তি। এর মধ্যে যুবজোট নেতা শামীমুল হক ছিলেন। তিনি নিজেকে পৌর মেয়র আনোয়ারুল কবিরের লোক বলে পরিচয় দেন। এ ঘাটে ইয়াছির আরাফাত নামে এক ব্যক্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলামের পক্ষে দেখাশোনা ও টাকা তোলেন।
কথা হলো গোলাপনগর মৌজার মহরাজপুর এলাকার তিন কৃষক মঈনুল, আবদুর রহমানের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, দিনে-রাতে মিলিয়ে এ স্থান থেকে চার শতাধিক যানে বালু উত্তোলন করছেন জাসদ-আওয়ামী লীগের নেতারা।
পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা এক্সকাভেটর (মাটিকাটার যন্ত্র) চালক মোহাম্মদ হৃদয় বলেন, প্রতিদিন তাঁরা একটি যন্ত্র দিয়ে ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাকে বালু ভরতে পারেন। চারটি এক্সকাভেটর দিয়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক বালু ও মাটি উঠছে।
বালু পরিবহনে নিয়োজিত এক ট্রাকচালক জানান, বড় ট্রাক থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, মাঝারি এক হাজার টাকা ও ছোট যানবাহন থেকে ৬০০ টাকা করে নিচ্ছে। টাকা নিলেও কোন রশিদ দেওয়া হয় না।
বাগগাড়িতে টাকা তোলেন মধ্য গোলাপনগর এলাকার বাসিন্দা লিমন সর্দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বালু উঠছে, ইজারা নেওয়া হয়েছে। কারা ইজারা দিয়েছেন জানতে চাইলে সরল জবাব—‘দলীয়ভাবে মহাজোট চালাচ্ছে।’ তাঁদের নাম কী—এমন প্রশ্নের উত্তরে লিমন সর্দার বলেন, জাসদের নেতা আবদুল আলিম ওরফে স্বপন, মেয়র আনোয়ারুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আক্তারুজ্জামান।
বাগগাড়ি এলাকায় নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বহনের দায়ে তিনজনকে ৫০ হাজার টাকা করে দেড় লাখ টাকা গত রোববার জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই জরিমানা করায় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা সন্ধ্যায় ভেড়ামারা শহরে সড়কে অবরোধ করেন। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা নতুনপাড়ার কৃষক আবদুল কাশেম, বজলুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন চেয়ারম্যান সোহেল রানা ও তাঁর লোকজন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক বরাবর গত ১৪ জানুয়ারি লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর একদিন ইউএনও সরেজমিনে এসেছিলেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে জানালেও মাটি কাটা বন্ধ হয়নি।’
রায়টা নতুনপাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, জমিতে কৃষকদের রোপণ করা বাদামগাছ গজিয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে। বড় হচ্ছে সেগুলো। কৃষক ও জমির মালিক ইলাহী বক্স বলেন, তিনি ২০ বিঘা জমিতে বাদামগাছ রোপণ করেছেন। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। বাদামের গাছসহ মাটি কেটে নেওয়ায় অনেক লোকসান হচ্ছে।
বাহাদুর ইউপিতে গিয়ে কথা হয় চেয়ারম্যান সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি মাটি কাটার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসিনা মমতাজ বলেন, ‘আমি গিয়েছিলাম বিষয়টি দেখতে। এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমার অফিসের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বাংলা সনের ১ তারিখ থেকে এক বছরের জন্য বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের আওতায় জেলাতে পদ্মা-গড়াই নদে ১৩টি বালুমহাল ইজারা দেওয়া আছে। তবে ভেড়ামারা এলাকায় পদ্মা নদীতে কোনো বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে বালু তুলতে দেওয়া হবে না।