চট্টগ্রাম নগরের বাদুরতলায় আরাকান সড়কের ঠিক পাশেই পুরোনো চারতলা ভবন। ভবনটিতে রয়েছে চিকিৎসকের চেম্বার, ওষুধ ও ফটোকপির দোকান। পরিবার নিয়েও ভবনটির একাংশে বসবাস করেন লোকজন। এই ভবনে রয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিত তৃণমূল বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার কার্যালয়। ভবনের দোতলার একটি মাত্র কক্ষে দলের তিন সাংগঠনিক জেলার কার্যালয়। যদিও দিনের বেলায় তা তালাবদ্ধ থাকে।
গতকাল শনিবার বেলা তিনটায় নগরের বাদুরতলার কামাল ম্যানশনে গিয়েও এই চিত্র দেখা যায়। চারতলা ভবনের একাধিক মালিক রয়েছেন। তবে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থাকার বিষয়টি ভবনের আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই জানেন না। ভবনের সামনে বা দেয়ালে কোনো ধরনের সাইনবোর্ড বা ব্যানার দেখা যায়নি। ৭ নভেম্বর এই কার্যালয় উদ্বোধন করেন দলের নেতারা।
ভবনের মালিকপক্ষের একজন অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল বিএনপির লোকজন তথ্য গোপন করে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। তাঁরা অফিস করার কথা বললেও কী ধরনের অফিস করবেন, তা বলেননি। তাঁদের ভবনে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় রাখতে দেওয়ার পক্ষপাতী নন তিনি।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী দিতে যাচ্ছে তৃণমূল বিএনপি। মূলত বিএনপির সাবেক নেতাদের কেউ কেউ এই দলের ব্যানারে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) ভিপি ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নাজিম উদ্দিন ও জিএস আজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকায় এই দলটির নেতারাও তৃণমূল বিএনপির হয়ে নির্বাচন করবেন। আগামী নির্বাচনে দেশের সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল দলটি। যদিও এখন ‘যোগ্য প্রার্থী’ খুঁজে পাচ্ছে না দলটি।
তৃণমূল বিএনপির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের খোঁজে গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের বাদুরতলায় যান প্রথম আলোর প্রতিবেদক। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ দলটির রাজনৈতিক কার্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেননি। পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর খানের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিলে তিনি কার্যালয়ের ঠিকানা দেন।
ওই ঠিকানা ধরে কামাল ম্যানশনে গিয়ে দেখা যায়, চারতলা ভবনের বাইরে দেয়ালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড (পরিচিতি ফলক)। তবে তৃণমূল বিএনপির কোনো সাইনবোর্ড বা ব্যানার ছিল না। ভবনটির নিচতলায় ওষুধের (ফার্মেসি) এবং কম্পিউটারের দোকান। দোতলার এক পাশে ওষুধের দোকানের গুদাম। আরেক পাশে সারি সারি তিনটি কক্ষ। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়। তবে তা ছিল তালাবদ্ধ।
কক্ষটির সামনে অপেক্ষা করার সময় নাছির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি সেখানে হাজির হন। তিনি নিজেকে ভবনের মালিকপক্ষের একজন হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সাত ভাই। এটি তাঁদের পৈতৃক ভবন। তৃণমূল বিএনপি যে কক্ষটি ভাড়া নিয়েছে, সেটির মালিক তাঁর মেজ ভাই মেজবাহ উদ্দিন। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ও ছেলে এটার মালিক। তবে মেজবাহ উদ্দিনের পরিবার ভবনটিতে থাকে না।
কামাল ম্যানশনে বর্তমানে চারটি পরিবার, একটি দন্ত চিকিৎসকের চেম্বার ও একটি গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে একটি পরিবার ভবনমালিকের ছেলে নাছির উদ্দিনের, একটি তাঁর বড় ভাই ও আরেকটি তাঁর বড় ভাইয়ের মেয়ের। এ ছাড়া দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষ একটি পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
নাছির উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই ভবনে তিনি ও তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের পরিবার পৃথকভাবে বসবাস করে আসছে। একটি বাসা এক পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে চিকিৎসকের চেম্বার ও দোকান রয়েছে। এর মধ্যে যে কক্ষটি ফাঁকা ছিল, সেটি ভাড়া নিয়েছে তৃণমূল বিএনপি। তৃণমূল বিএনপির লোকজন তাঁর ভাবি ও ভাতিজাকে অফিসের কথা বলে কক্ষটি ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু কী ধরনের অফিস করবে সেটি আর স্পষ্ট করেননি। আর এখানে পরিবার নিয়ে তাঁরা থাকেন, সেখানে কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থাকে?
তৃণমূল বিএনপি যখন সাইনবোর্ড ও ব্যানার টানিয়েছিল, তা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন বলে জানান নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, এখানে এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থাকতে পারবে না।
তৃণমূল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর খান এই কার্যালয়ে নিয়মিত বসেন বলে প্রথম আলোকে জানান। তবে শনিবার তালাবদ্ধ থাকার বিষয়ে আকবর খান বলেন, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তাঁরা সবাই এখন ঢাকায় আছেন। এ জন্য কার্যালয়ে তালা দেওয়া। তবে রোববার থেকে আবার খোলা থাকবে।
ভবনমালিকদের একজন নাছির উদ্দিনের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে আকবর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে কক্ষটি ভাড়া নিয়েছি, তার মালিক নাছির উদ্দিন নন। তাঁর (নাছির) ভাইয়ের স্ত্রী। আমরা তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ থেকে অফিস করার কথা বলেই কক্ষ ভাড়া নিয়েছি দুই বছরের জন্য। তিনি কাকে ভাড়া দেবেন বা দেবেন না, এটা তো নাছির উদ্দিন ঠিক করার কেউ নন। এখানে কোনো লুকোচুরি নেই।’
তবে আকবর খান স্বীকার করেছেন রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার কথা মালিকপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়নি।
তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়ের পাশের এক ভাড়াটে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদিন সন্ধ্যার পর কক্ষটিতে লোকজন আসেন। কিছুক্ষণ পর তাঁরা উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন। এতে তাঁদের পড়ালেখা ও স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে বিরক্তির কথা জানালে দরজা বন্ধ করে সভা করতে থাকেন।