বৈরী আবহাওয়ায় সড়ক, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের ন্যূনতম গতিসীমা মানা হচ্ছে না। কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় সামনের কিছু একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো একেবারে বন্ধ রাখার কথা বলা আছে; কিন্তু সেই নির্দেশনা কেউ মানছেন না। এ জন্যই ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে গত দুই দিন একাধিক যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।
সড়ক সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গতকাল সোমবার ও আগের দিন রোববার মুন্সিগঞ্জে এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা মহাসড়কটির সাইন-সংকেতব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। এর আগে যমুনা সেতু চালুর পর সেতুটির আগে-পরে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার ধরন হচ্ছে, ঘন কুয়াশার কারণে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে পেছন থেকে একের পর এক যান এসে ধাক্কা দেয়। একে ‘পাইল আপ’ বলে। এ জন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।
গত দুই দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এবং সড়কের সংকেতব্যবস্থা দায়ী।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ভোরে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুঁচিয়ামোড়া এলাকায় ঘন কুয়াশার মধ্যে তিন শিশুসহ সাতজনকে বহনকারী একটি প্রাইভেট কার এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঢাকার দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটি ট্রাক গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়। এরপর গাড়ির লোকজন নেমে ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখন আরেকটি কাভার্ড ভ্যান এসে ট্রাকটিকে ধাক্কা দিলে প্রাইভেট কারের যাত্রীদের ওপর উঠে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান এক যাত্রী।
আগের দিন রোববার ভোরে কুয়াশার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাসাড়া এলাকার চারটি স্থানে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, কাভার্ড ভ্যানসহ ১০টি যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসব যানবাহন কোথাও সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা খায়, কোথাও একটি গাড়ি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দেয়। ওই দুর্ঘটনায় মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামের গাড়ির এক চালক মারা যান।
স্বাভাবিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়েতে কার, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, মিনিট্রাকসহ সব ধরনের মালবাহী যানের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। এই নীতিমালা কেউ মানছেন না।
শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস ও হাসাড়া হাইওয়ে থানার হিসাবে, চলতি ডিসেম্বরের ২৩ দিনে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছেন। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮০ জন আহত হয়েছেন। মারা গেছেন ১৬ জন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এবং সড়কের সংকেতব্যবস্থা দায়ী। ঘন কুয়াশার সময় হাইওয়ে পুলিশ কিছু দূর দূর অবস্থান নিয়ে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ করার কথা। তাদের উপস্থিতিই চালকদের সতর্ক হয়ে চালাতে বাধ্য করত। সেটা তারা করছে না। আর সবচেয়ে দামি সড়কে মান্ধাতার আমলে সাইন-সংকেতব্যবস্থা রাখা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ এসব ব্যবস্থার খরচ খুব সামান্য।
সড়ক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া কিংবা দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে বাংলাদেশে ফেরি ও বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ বা কত গতিতে চলতে দেওয়া উচিত—এ বিষয় দেখভাল করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আধুনিক মহাসড়কগুলোয় ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে গতি দেখানোর সংকেত বা সাইনবোর্ড থাকে। সেই অনুযায়ী তা মানা হচ্ছে কি না, তা হাইওয়ে পুলিশের দেখার কথা। কিন্তু অবকাঠামো, যানবাহন ও জনবল থাকার পরও হাইওয়ে পুলিশ তা করে না। আর মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েকে বিপুল টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক মানের করা হলেও এর সাইন-সংকেতব্যবস্থা আধুনিক নয়।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটিকে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়। এর নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। মহাসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা বিশ্বে বিরল। ৫৫ কিলোমিটার এই মহাসড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকা।
গত মে মাসে সড়ক ও মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহন কোন গতিতে চলাচল করতে পারবে, এ–সংক্রান্ত বিধিমালা প্রকাশ করে সরকার। এতে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে এক্সপ্রেসওয়েতে কার, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাসের সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, মিনিট্রাকসহ সব ধরনের মালবাহী যানের গতিবেগ সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার। আর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। এই নীতিমালা কেউ মানছেন না।
বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ গতিসীমার এই নির্দেশনা শুধু স্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রযোজ্য। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা হলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গতিসীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ যতটুকু গতি হলে চালক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, সেই অনুযায়ী চালাতে হবে। তবে দৃষ্টিসীমা বেশি মাত্রায় কমে গেলে বা একেবারে দেখা না গেলে যানবাহন চালানো বন্ধ রাখতে হবে। বৈরী আবহাওয়ায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
সড়ক আইন মেনে যদি চালকেরা গাড়ি চালাতেন, তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটত না।ওসি আবদুল কাদের জিলানী
গতকাল কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় নিহত নারীর নাম পান্না বণিক (৩৫)। তিনি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার বসাকপাড়া এলাকার বাসিন্দা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর বোনের মেয়ে তুষি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় আধা ঘণ্টা আমার মাসি ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে ছিল। কেউ উদ্ধার করতে আসেনি। আমাদের অন্য আহতরাও ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। আধা ঘণ্টা পর পুলিশ আসে।’
গতকাল বেলা তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা থেকে শুরু করে শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে পুলিশের কোনো গাড়ি দেখা যায়নি। সড়কের কোথাও পুলিশের কোনো অবস্থানও চোখে পড়েনি। মহাসড়কের পাশের স্টিলের বোর্ডে গতিসীমা লেখা আছে। কোথাও ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। আবার কোথাও ৬০ বা ৮০ কিলোমিটার। তবে কেউ মানছেন কি না, দেখা হচ্ছে না। অথচ হাইওয়ে পুলিশের কাছে গতি মাপার যন্ত্র রয়েছে। এ ছাড়া বোর্ডে লেখা গতিসীমা ঘন কুয়াশায় দেখা যায় না। বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল নির্দেশনাও নেই।
এ বিষয়ে হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জিলানী বলেন, প্রতিদিন রাতে দুটি গাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীর টোল প্লাজা থেকে শুরু করে মাওয়া এলাকার প্রায় ২৯ দশমিক ২ কিলোমিটার এলাকায় টহল দিচ্ছেন তাঁরা। সে সময় চালকদের বারবার ট্রাফিক আইন মেনে এবং কম গতিতে গাড়ি চালাতে বলা হচ্ছে। তাঁদের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও তাঁদের থেকে দূরে গিয়ে আবার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালকেরা। অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে ওসি বলেন, সড়ক আইন মেনে যদি চালকেরা গাড়ি চালাতেন, তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটত না।
বেপরোয়া চালক ও পরিবহনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আইনি কার্যক্রম চলছে বলে দাবি করলেন মুন্সিগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
হাসাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রদীপ দাস ও হুমায়ন আহমেদ বলেন, কুচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী সেতুর টোল প্লাজা, হাসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানা এলাকার কাছাকাছি এক্সপ্রেসওয়েতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নামমাত্র টহল দেয়। এ টহলে এক্সপ্রেসওয়েতে কোনোভাবে দুর্ঘটনা কমাতে পারবে না। দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তাচৌকি বসানো দরকার।