সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে যাচ্ছেন দৈনিক ৪ হাজার পর্যটক, জাহাজমালিকেরা বলছেন ‘সাড়া মিলছে না’

টেকনাফের দমদমিয়া জেটিঘাট দিয়ে জাহাজে উঠছেন পর্যটকেরা। আজ মঙ্গলবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার সকাল নয়টা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকেরা জড়ো হয়েছেন টেকনাফের দমদমিয়া ঘাটে। উদ্দেশ্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ। একে একে টিকিট সংগ্রহ করে নাফ নদীতে অপেক্ষমাণ নয়টি জাহাজে ওঠেন তাঁরা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ছাড়ল জাহাজগুলো।

আটলান্টিক ক্রুজ নামের জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৩৪৬ জন। এই দুই প্রতিবেদকসহ পর্যটক ওঠেন ৩২০ জন। ফলে বেশ কিছু আসন খালি। প্রকারভেদে জনপ্রতি টিকিট এক থেকে দুই হাজার টাকা। জাহাজের সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর জানান, ১ নভেম্বর থেকে টানা দুই মাস জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। চালু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি। এ কারণে পর্যটকের আগমন তেমন ঘটছে না। প্রতিদিন আসন খালি যাচ্ছে।

আটলান্টিক ক্রুজের পেছনে এমভি বার আউয়ালিয়া। ধারণক্ষমতা ৫৫২ জন। যাত্রী উঠেছে পাঁচ শতাধিক। নাফ নদীর শান্ত জল অতিক্রম করে সেন্ট মার্টিনের দিকে ছুটছে কেয়ারি সিন্দাবাদ, এমভি পারিজাত, এমভি রাজহংস, এসটি ভাষাশহীদ সালাম, বে ক্রুজ, এসটি শুকান্তবাবু, এমভি বার আউলিয়াসহ কয়েকটি জাহাজ। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে জাহাজগুলো পৌঁছাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে।

টিকিট কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি জাহাজে গড়ে ৩৫০ জন পর্যটক রয়েছেন। এ হিসাবে ৯টি জাহাজে ওঠেন ৩ হাজার ১৫০ জন। দ্রুতগতির ৩০টি স্পিড বোট, ২৮টি সার্ভিস ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন গেছেন আরও ৭০০ জন। ৭০০ জন ধারণক্ষমতার এমভি কর্ণফুলী জাহাজ নিয়ে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন গেছেন ২০০ জন পর্যটক। সব মিলিয়ে আজ ১০টি জাহাজ ও ৫৮টি নৌযানে চড়ে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন ৪ হাজার ৫০ জন।

নাফ নদীর পশ্চিম পাশে টেকনাফ শহর, টেকনাফ স্থলবন্দর, ২৭৭ ফুট উঁচু দেবতার পাহাড় নেটং। এরপর সম্রাট শাহ সুজা ও তাঁর স্ত্রী পরীবানুর নামের প্রথমাংশ দিয়ে নামকরণের ‘শাহপরীর দ্বীপ’। টেকনাফের দমদমিয়া জেটিঘাট থেকে শাহপরীর দ্বীপ অতিক্রম করতে জাহাজের সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। বাকি এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন পৌঁছতে।

নাফ নদীর পূর্ব দিকে মিয়ানমারের রাখাইনরাজ্যের মংডু শহর। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাখাইন রাজ্যের শত কিলোমিটার সীমান্ত ঘিরে রাখা হয়েছে। খোলা মাঠে টিনের ছাউনিযুক্ত দেশটির সীমান্তরক্ষীর একাধিক চৌকি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের মুখে আট লাখ রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিল। সাড়ে পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।

নাফ নদীর বুকে মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়ল না। তবে নদীর মিয়ানমার অংশে মাছ ধরছেন রাখাইন রাজ্যের জেলেরা। মাদক চোরাচালান ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এখনো সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ।

টেকনাফের জেটিঘাট থেকে পর্যটক নিয়ে সেন্ট মার্টিনে ছুটছে জাহাজ। নাফনদী ও বঙ্গোপসাগরে নীলজলের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করছেন পযটকেরা। আজ মঙ্গলবার সকালে

আটলান্টিক ক্রুজ জাহাজে চড়ে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন টেকনাফের জালিয়াপাড়ার জেলে জাফর আলম। রাখাইন রাজ্যের দিকের তাঁর দৃষ্টি। জাফর আলম (৪৫) বলেন, একটা সময় নাফ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন উপজেলার ১০ হাজারের বেশি জেলে। নিষেধাজ্ঞার কারণে জেলেরা বেকার এবং অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। দ্রুত এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জরুরি।

নাফ নদী দিয়ে ছুটছে জাহাজ। পেছনে গাঙচিলের দল। যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আটলান্টিক জাহাজের নাবিক ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা দিচ্ছেন, গাঙচিলকে চিপস, বিস্কুট, পাউরুটি না দিতে। চিপস, প্লাস্টিক, পানীয়ের বোতল নদীতে না ফেলতে। সেদিকে নজর নেই কারও।

আটলান্টিক জাহাজের ব্যবস্থাপক আব্দুল আজিজ বলেন, নাফ নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ এবং গাঙচিলকে খাবার ছিটানো নিষেধ। তারপরও কাজটি করে চলেছেন যাত্রীরা।
কেয়ারি জাহাজের ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান বলেন, ২০০৪ সাল থেকে জাহাজটি এই নৌপথে পর্যটক পারাপার করছে। পরিবেশ রক্ষায় তাঁরা সচেতন, পর্যটকদেরও সচেতন করে নিয়মিত প্রচারপত্র বিলি করেন।

কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জাহাজের টিকিট মাথাপিছু ১ থেকে ২ হাজার টাকা, যা গত বছর ছিল ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা থেকে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছে এমভি কর্ণফুলী এবং সপ্তাহে এক দিন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করে বিলাসবহুল প্রমোদতরি বে-ওয়ান। ভাড়া ৩ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যাচ্ছেন চার হাজারের বেশি পর্যটক। এর মধ্যে গড়ে আড়াই হাজার পর্যটক দ্বীপের দুই শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট ও কটেজে রাত যাপন করেন। অন্যরা বেলা তিনটার দিকে জাহাজে ফিরে আসেন টেকনাফ।

আজ ১০টি জাহাজ ও ৫৮টি নৌযানে চড়ে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন ৪ হাজার ৫০ জন

গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে ১০টি জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। তাতে পর্যটক ভ্রমণসেবায় নিয়োজিত ট্যুর অপারেটরদের পাশাপাশি ট্যুর গাইড, হোটেল মোটেল, গেস্টহাউস, রেস্টহাউস, ফ্ল্যাট ও কটেজ ব্যবসায়ী-কর্মচারীসহ অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ বিপাকে পড়েন। এখন লোকসান ওঠানোর চেষ্টা চলছে জানিয়ে জাহাজমালিকদের সংগঠন সি-ক্রোজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, মৌসুমের মাঝামাঝি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় পর্যটকদের তেমন সাড়া মিলছে না। আগামী মার্চ পর্যন্ত এই রুটে জাহাজ চলাচল করবে।

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, ১০ জাহাজে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন। সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৪ জন পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে গেছেন গত শুক্রবার। টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পুনরায় জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে পর্যটকের সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ কমে গেছে। কক্সবাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া এমভি কর্ণফুলীতে আজ সেন্ট মার্টিন গেছেন ১৫০ জন। গতকাল গেছেন ১২৬ জন। জাহাজটি ধারণক্ষমতা ৭০০ জন।

জাহাজে সিটে বসে দেড় বছরের একমাত্র মেয়েকে খাওয়াচ্ছিলেন ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা ব্যবসায়ী শরিফুর রহমান। সঙ্গে স্ত্রী। তিন বছর আগে তিনি একা সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেন। এবার যাচ্ছেন স্ত্রী ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। এক রাত থাকার ইচ্ছা তাঁদের। শরিফুর বলেন, তিন বছর আগে সেন্ট মার্টিনের যে রিসোর্টে দুই হাজার টাকায় থেকেছেন তিনি, সেটির ভাড়া এখন দ্বিগুণ। খাবারের দামও বেড়েছে অনেক। তারপরও ইচ্ছাপূরণ, দেশে তো সেন্ট মার্টিন আছে একটাই।