বেদেবহরের সদস্যদের একাংশ। আলমডাঙ্গার কালিদাসপুরে কুমার নদের পাড় থেকে তোলা
বেদেবহরের সদস্যদের একাংশ। আলমডাঙ্গার কালিদাসপুরে কুমার নদের পাড় থেকে তোলা

‘বাবু, আমাদের কথা লিখে কী হবে? পারলে কিছু চাল দে, শীতের একটা কম্বল দে’

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে রেলপথ বা সড়কপথে কুষ্টিয়ায় যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ে কুমার নদ। এর উত্তর পাড়ে কালিদাসপুর এলাকায় সম্প্রতি তাঁবু গেড়েছে ২৫টি বেদে পরিবার। বাঁশ ও মোটা পলিথিন দিয়ে বানানো অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছে তারা। তীব্র শীতে করুণ অবস্থায় দিন পার করছে এসব ছিন্নমূল মানুষ।

কয়েক দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় শীতের প্রকোপ চলছে। তবে প্রশাসন বা সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন কোনো সহায়তা পাননি। তাঁরা বলছেন, এ সময় কেউই তাঁদের জন্য এগিয়ে আসেনি, দেয়নি কম্বল বা শীতবস্ত্র। তাই চরম কষ্টের মধ্যে সময় পার করতে হচ্ছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, নদের পাড়ে কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও বেদেবহরে বেশির ভাগ শিশুর গায়ে কোনো পোশাক নেই। কারও শরীরে পোশাক থাকলেও সেটি শীত নিবারণের জন্য উপযুক্ত নয়। বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কেউ কেউ গোসলের পর গামছা পরে রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা লুঙ্গি শুকাতে দিয়েছেন। আর তাঁবুর পাশেই কয়েকজন নারী রান্নায় ব্যস্ত।

এক নারী সবজি রান্না করছিলেন, অদূরে বসে দুই বছর বয়সী এক শিশু অনবরত কেঁদে চলেছে। শিশুটি ক্ষুধা নাকি শীতের প্রকোপে কাঁদছিল—তা ঠিক ঠাওর করা গেল না। এসব দেখতে দেখতেই বেদেবহরের দলনেতাসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

২৫টি পরিবারের শতাধিক সদস্য নিয়ে মাত্র ১৭ দিন আগে সাভারের পোড়াবাড়ি এলাকা থেকে রওনা হয়েছিল বেদেবহরটি। সম্প্রতি তারা আলমডাঙ্গার কালিদাসপুরে তাঁবু গেড়েছে। মধ্যে কয়েক দিন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটে ছিল তারা।

২৫টি পরিবারের শতাধিক সদস্য নিয়ে মাত্র ১৭ দিন আগে সাভারের পোড়াবাড়ি এলাকা থেকে রওনা হয়েছিল বেদেবহরটি। সম্প্রতি তারা আলমডাঙ্গার কালিদাসপুরে তাঁবু গেড়েছে। মধ্যে কয়েক দিন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটে ছিল তারা। বেদে সম্প্রদায়ের দলনেতা মোহাম্মদ শেখ মিয়া (৬০) প্রথম আলোকে জানান, চৌদ্দ পুরুষের পেশা হিসেবে বেদে সম্প্রদায়ের পুরুষেরা গাছগাছড়া দিয়ে চিকিৎসা ও সাপের খেলা দেখিয়ে আয়রোজগার করেন। আর উপার্জন করেন শিঙা লাগিয়ে বাত-ব্যথা সারিয়ে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই জীবিকার সন্ধানে তাঁদের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ছুটতে হয়।

দুই স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বহরটির সঙ্গে বের হয়েছেন মাহাতাব বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা কইরেও জাত পেশা ছাড়তে পারিনে। ছেলেরাও গার্মেন্টসে চাকরি করতে চায়নে। সবাই মিলেই আদি পেশাটাকাকে টিকিয়ে রাকছি।’ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ পাঁচটি শিশু এসে এই প্রতিবেদককে ঘিরে ধরে। তাদের কারও গায়েই জামা নেই। শিশুদের কেউ কেউ প্রতিবেদকের কাছে গিয়ে নিজেদের আবদারের কথা শোনায়। বলছে, ‘বাবু, তুই আমাকে নতুন জামা কিনে দিবি; সোয়েটার কিনে দিবি।’

সেখানে মোহাম্মদ জিনারুল নামের এক বেদে সদস্য এসে জানান, তাঁর পরিবারের সদস্যদের কোনো গরম জামাকাপড় নেই। পোশাকের অভাবে বাচ্চাদের খালি গায়ে থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় কাঁথা–কম্বল না থাকায় শীতের রাতগুলো অনেক কষ্টে পার করতে হচ্ছে।

শীতবস্ত্র না থাকায় বেদেবহরের সদস্যরা কনকনে শীতে সীমাহীন কষ্টে আছে। নদের ধারে বসবাস করায় বেশি সমস্যায় ভুগছে তারা। সরকার ও বিত্তবানদের উচিত, অসহায় এই বেদে পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তাদের খবর রাখছে না কেউ।
সিরাজুল ইসলাম, আলমডাঙ্গা উপজেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক

বেদে সম্প্রদায়ের শীতের কষ্ট কমাতে সরকার ও বিত্তবানদের এ গিয়ে আসার আহ্বান জানান নাগরিক সংগঠন আলমডাঙ্গা উপজেলা লোকমোর্চার সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শীতবস্ত্র না থাকায় বেদেবহরের সদস্যরা কনকনে শীতে সীমাহীন কষ্টে আছে। নদের ধারে বসবাস করায় বেশি সমস্যায় ভুগছে তারা। সরকার ও বিত্তবানদের উচিত, অসহায় এই বেদে পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তাদের খবর রাখছে না কেউ।’

বেদেবহরে একই কথা জানিয়েছিলেন শামসুন্নাহার (৫০) নামের এক নারী। আক্ষেপ, অভিমান কিংবা অভিযোগের সুরে তিনি বলেন, ‘বাবু, আমাদের কথা লিখে কী হবে? পারলে কিছু চাল দে, তরকারি দে, শীতের একটা কম্বল দে।’

এ বিষয়ে আজ সকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, বিষয়টি মাত্রই জানলেন। আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে শীতার্ত বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুততম সময়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।