পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের (কাদিয়ানি) সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে আন্দোলন ও সংঘর্ষের ঘটনার পর আজ সোমবার সকাল থেকে জেলা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সকাল ৯টার পর থেকেই শহরে মানুষজনের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করেছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জেলা শহর ও শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের টহল-নজরদারি রয়েছে।
ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত হওয়া ছয়টি মামলায় মোট ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। এর আগে গত শনিবার গভীর রাত থেকে গতকাল রোববার দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল গভীর রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাকিদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে নিরপরাধ কাউকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।
হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়। এরপর গতকাল রাতে পঞ্চগড় সদর থানায় র্যাব বাদী হয়ে একটি এবং পুলিশ বাদী হয়ে আরও দুটি মামলা করে। এখন পর্যন্ত দায়ের হওয়া ছয়টি মামলায় ৮ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে শনিবার রাতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তরুণ জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর শহরের দক্ষিণ রাজনগর এলাকার ঈসমাইল হোসেন (২৫) এবং তুলারডাঙ্গা এলাকার মো. রাসেলকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার দুজনেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ হাসানকে পিটিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে।
এ ছাড়া শনিবার রাতে মোটরসাইকেলে চেপে শহরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পঞ্চগড় পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলে রাব্বী (৩০) এবং ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তেঁতুলিয়া উপজেলার সাতমেড়া এলাকার রাব্বী ইমনকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের নাম এখনো জানা যায়নি।
এদিকে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর থেকেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
এর আগে শনিবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত পুরো জেলাজুড়ে মুঠোফোনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। তবে এ সময় মুঠোফোনে কথা বলা গেছে। আজ সকাল সোয়া ১০টার পর থেকে মুঠোফোনের ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাচ্ছে বলে ব্যবহারকারীরা জানিয়েছেন।
জেলা পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা আজ সকালে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে জেলার পরিবেশ বর্তমানে স্বাভাবিক আছে। এখন পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে মোট ৮১ জন। অপরাধীদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। তবে ভিডিও ফুটেজ দেখে, সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ঘটনায় কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হবে না।
পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জলসা বন্ধের দাবিতে শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। একদল বিক্ষোভকারী আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এ পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। এ ঘটনায় দুজন নিহত ও পুলিশসহ অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এ ঘটনার আগে বৃহস্পতিবার একই দাবিতে বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক বরাবর আহমদিয়াদের সালানা জলসা বন্ধের দাবিতে ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা কয়েকটি সংগঠন স্মারকলিপি দেয়। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল পৌনে চারটা পর্যন্ত জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিল ইসলামী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ওই দিন বিকেল ৪টায় একদল বিক্ষুব্ধ মানুষ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের দুটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর করে।
এ দিকে শনিবার রাত আটটা পর্যন্ত পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় শহরের পরিবেশ শান্ত ছিল। রাত পৌনে নয়টায় একটি মোটরসাইকেলে দুজন আরোহী দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থানরত মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন। তাঁরা বলছিলেন, শহরের তুলারডাঙ্গা এলাকায় আহমদিয়াদের কয়েকজন আমাদের (মুসলিমদের) দুজনের গলা কেটে দিয়েছেন। এ কথা শোনার পর মুহূর্তেই শহরের রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ। হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে নারায়ে তকবির ধ্বনি তোলে তাঁরা দুই ভাগ হয়ে আহম্মদনগর ও তুলারডাঙ্গা এলাকার দিকে ছুটতে থাকেন। এ সময় পঞ্চগড় বাজারের ওয়াকার শোরুম নামে একটি জুতার দোকানের সাটার ভেঙে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় একদল মানুষ। একই সময় জেলা শহরের ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় র্যাবের ব্যবহার করা একটি মাইক্রোবাস পুড়িয়ে দেন একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। কিছু সময় পরে পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে বিভিন্ন মসজিদে মাইকের মাধ্যমে ও জেলা প্রশাসন থেকে সড়কে মাইকে প্রচারণা চালানো হয়। শহরের কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। স্বার্থান্বেষী একটি মহল গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। মানুষকে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করার আহ্বান জানানো হয়। এর পর গভীর রাত থেকে পরিস্থিতি শান্ত হয়।