টিলাটির অবস্থান সড়কলাগোয়া। সড়কের পাশসহ তিন দিক দেয়ালঘেরা থাকায় টিলাটি দেখা যায় না। ভেতরে কী হচ্ছিল, তা-ও বোঝা যাচ্ছিল না। দিনের বেলায় এ রকম বদ্ধ অবস্থা তৈরি করে রাতে এক্সকাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে চলছিল টিলা কাটা। দেয়ালের আড়ালে টিলা সাবাড়ের এ চিত্র সিলেট শহরতলির খাদিমপাড়া খুনিরচক মুকামের গুল এলাকায়।
টিলাটি কেটে আশপাশের আবাসিক এলাকা ভরাট করা হচ্ছিল। স্থানীয় ও পরিবেশকর্মীরা একাধিকবার বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ বুধবার সকাল নয়টার দিকে অভিযান চালান পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অভিযানে টিলার পাশের একটি ঝোপের আড়ালে পাওয়া যায় একটি খননযন্ত্র। অভিযানে খননযন্ত্রটি পুলিশের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। তলব করা হয়েছে টিলার মালিককে।
অভিযান ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ সকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল খাদিমপাড়া খুনিরচক মুকামের গুল এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানকালে দেয়ালঘেরা সীমানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের অবস্থানের জন্য ছোট কুঁড়েঘর আকারের একটি ঘর ধ্বংস করা হয়। টিলাটির মালিক প্রবাসী পিন্টু চৌধুরী বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও টিলা কাটার কাজে থাকা কাউকে পাননি। তবে টিলা কাটার সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ পান তাঁরা। এ সময় ঝোপের আড়ালে থাকা একটি এক্সকাভেটর জব্দ করা হয়।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে অভিযানে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশের একটি দল। এ সময় পুলিশই বাবুল আহমদ (৪০) নামের একজনকে হাজির করেন। পরে বাবুল আহমদের নামে নোটিশ জারি করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এক্সকাভেটরটি জব্দ করে সেটি শাহপরান থানা-পুলিশের জিম্মায় দেওয়া হয়।
অভিযানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সদস্য ফাদার যোসেফ গমেজ। তিনি বলেন, টিলার চার ভাগের প্রায় তিন ভাগ অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। ওপর থেকে কেটে ফেলায় উচ্চতায় এখন ২০ ফুট আকার ধারণ করেছে কয়েকটি টিলা। ওই স্থানে মাটি কাটার অন্যান্য যন্ত্র চলাচলের ছাপও রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বলেন, ওই জমির মালিক প্রবাসী। বাবুল আহমদ নামের এক ব্যক্তি সেটি দেখভাল করেন বলে জানিয়েছেন। তাঁকে বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদপ্তরে হাজির হওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর আগেও বাবুল আহমদের নামে টিলা কাটার অভিযোগে একাধিকবার জরিমানা করার তথ্য রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ক্ষতিপূরণ আরোপের জন্য এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়েছিল। সেটির প্রক্রিয়া রয়েছে। বৃহস্পতিবার সেটির শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। পরে বিষয়টি ঢাকায় প্রেরণ করা হবে।
অভিযানের পর সরেজমিনে দেখা গেছে, দেয়াল দিয়ে টিলার তিন দিকে আবদ্ধ। সড়কের পাশ দিয়ে দেয়াল করায় ভেতরে কী আছে, দেখা মুশকিল। দেয়ালের একটি অংশে টিনের দরজা দেওয়া। সেটি পেরিয়ে প্রায় ৫০ গজ এগিয়ে গেলে লাল রঙের লোহার দুটি দরজা। স্থানীয় লোকজন জানান, দিনের বেলা সুনসান নীরব থাকলেও রাত নামলেই শুরু হয় টিলা কাটা। দিনের বেলায় মাটি কাটার যন্ত্রগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।
খননযন্ত্র দিয়ে টিলা কাটায় অভিযুক্ত বাবুল আহমদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনি সেখানে কোনো টিলা কাটার ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। খননযন্ত্র পাওয়ার বিষয়টি জানেন না বলেও দাবি করেন বাবুল। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন এবং নোটিশের জবাব দেবেন বলে জানিয়েছেন। টিলা কাটার অপরাধে এর আগে জরিমানা দিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে বাবুল বলেন, তিনি ওই জায়গার তত্ত্বাবধায়ক। ওই টিলা প্রায় আট বছর আগে কাটা হয়েছিল। সেটির নোটিশ পেলে পরবর্তী সময়ে সমস্যাটি মিটেও যায়। নতুন করে কোনো টিলা কাটার ঘটনা ঘটেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান ও মামলার পরও নানা কৌশলে এভাবে টিলা সাবাড় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটের সব টিলা এবং পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। টিলাগুলো টিকিয়ে রাখা এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে দায়ী।