মর্গের ভেতরে সারি করে রাখা হয়েছে সাতটি লাশ। একটু পরপর নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, বন্ধু, স্বজন ও সহকর্মীরা আসছেন আর একে একে লাশ শনাক্ত করছেন। তাঁদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে আশপাশের পরিবেশ।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে অবস্থান করে এই চিত্র দেখা গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনগত রাত তিনটার দিকে শিবপুর উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঘাসিরদিয়া এলাকায় পাথরবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের সাত যাত্রী নিহত হন। পুলিশ বলছে, আজ দুপুর পর্যন্ত সাতজনের লাশই শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
সাভারের আশুলিয়ার এসবি নিটিং লিমিটেড কারখানার কয়েক কর্মকর্তা জানান, মাইক্রোবাসটিতে অবস্থান করা ৯ জনই এ প্রতিষ্ঠানের কর্মী। তাঁদের মধ্যে আটজনই প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ডাইজার ও একজন ফেব্রিকস সেকশনের স্টোরকিপার। গতকাল রাত ১১টার দিকে আশুলিয়া থেকে চালকসহ ১১-১২ জন ওই মাইক্রোবাসে চড়ে সিলেটের দিকে রওনা হয়েছিলেন। এ দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন।
নিহত সাতজন হলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মীর কুমুল্লী গ্রামের মোতাহের হোসেনের ছেলে মীর নাজমুল হক ওরফে সবুজ (৩০), গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার লতিফপুর গ্রামের আইয়ুব খানের ছেলে আল আমীন খান (২৭), ঝালকাঠির রাজাপুর থানার পারগোপারপুর গ্রামের আবদুল গনি হাওলাদারের ছেলে আল আমীন হাওলাদার (২৯), জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার ধারাবর্ষা গ্রামের দুদু মিয়ার ছেলে রাজু আহাম্মেদ (৩৬), মাদারীপুরের কালকিনি থানার উত্তর কৃষ্ণনগর গ্রামের তোফায়েল হাওলাদারের ছেলে আবদুল আউয়াল (৩৭), বরিশালের মুলাদি থানার মুলাদি গ্রামের মো. মজিবর সিকদারের ছেলে রায়হান সিকদার ওরফে আরিয়ান (২৪) ও কুষ্টিয়ার সদর থানার খাজানগর গ্রামের নুরু মোল্লার ছেলে বাবুল মোল্লা (৪০)।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহত আল আমিন খানের ছোট ভাই আসিফ খান ছুটে আসেন নরসিংদী সদর হাসপাতালে। তিনি শ্রীমঙ্গলের একটি রিসোর্টে ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। আসিফ বলেন, ‘ভাইয়া সিলেটে ঘুরতে আসছেন শুনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তিনি কথা দিয়েছিলেন, আমার এখানে ঘুরতে আসবেন। সকালে আম্মু কল দিয়ে দুর্ঘটনার খবর জানান। এরপরই নরসিংদী সদর হাসপাতালে এসে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করি।’ এ কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েলেন তিনি।
সাভারের আশুলিয়া থেকে নাজমুলের মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছেন তাঁর বোন বর্ণা বেগম। তিনি জানান, সকাল সাড়ে ছয়টায় পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন করে মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এরপরই রওনা হয়ে নরসিংদীতে আসেন। মর্গে এসে নাজমুলের লাশ শনাক্ত করেছেন। বর্ণা বেগম বলেন, ‘সহকর্মী একদল বন্ধুর সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার খবর জানতাম। কিন্তু এভাবে তাকে হারানোর ব্যথা সহ্য হচ্ছে না।’
নিহত রায়হানের বাবা মজিবর রহমান বরিশাল থেকে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তখনো তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন না। বন্ধুদের সঙ্গে সিলেটে ঘুরতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় রায়হান আহত হয়ে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার খবর শুনে তিনি আসছিলেন। এই প্রতিবেদক মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মজিবর রহমান ফোন ধরে জানতে চান, তাঁর ছেলের শারীরিক অবস্থা এখন কেমন?
দুর্ঘটনার খবর শুনে ঝালকাঠির আল আমিন হাওলাদারের বন্ধু মো. ওয়ালিউল্লাহ মর্গের সামনে এসেছিলেন। তিনি জানান, আল আমিন ছিল তাঁর মা–বাবার একমাত্র সন্তান। মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করে সাভারের একটি প্রতিষ্ঠানে মার্চেন্ডাইজিং শেখেন। ২০১৪ থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মার্চেন্ডাইজারের কাজ করে আসছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নরসিংদীর সহকারী পরিচালক শেখ মো. ইমরান বলেন, মাইক্রোবাস ও ট্রাক উভয়েরই ফিটনেস ও কাগজপত্র ঠিকঠাক ছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে, পাথরবোঝাই ট্রাকটি সঠিক পথেই ছিল। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি গাড়িকে তার বাঁ দিক ধরে চলতে হয়। কিন্তু মাইক্রোবাসটি সঠিক পথে না থেকে চলে যায় ডান দিকের একেবারে শেষ প্রান্তে। হয়তো অন্য কোনো গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে মাইক্রোবাসটি ওই ট্রাকের সামনে চলে এসেছিল। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
নরসিংদী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারুনুর রশিদ জানান, নিহত সাতজনেরই লাশ শনাক্ত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জনই একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী। অন্যজন তাঁদের সঙ্গে চলাফেরা করেন, একসঙ্গে সিলেটে রওনা হয়েছিলেন। ময়নাতদন্ত শেষে তাঁদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
হারুনুর রশিদ আরও জানান, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস ও পাথরবোঝাই ট্রাক জব্দ করে ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা আছে। এ ঘটনায় আহত ট্রাকটির চালককে পুলিশি হেফাজতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে হাইওয়ে ফাঁড়িতে অবস্থান করছেন।
হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পাথরবোঝাই একটি ট্রাক ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। অন্যদিকে মাইক্রোবাসটি সিলেটের দিকে যাচ্ছিল। ঘাসিরদিয়া এলাকায় অন্য একটি গাড়িকে দ্রুতগতিতে ওভারটেক করতে গিয়ে মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এ সময় সামনে চলে আসা ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলেই মাইক্রোবাসের পাঁচ যাত্রী নিহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আরও দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।