আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ভ্রমণের সময় প্রথমে কিছু সমস্যায় পড়েছিলেন সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করা ভারতীয় ভূপর্যটক অক্ষয় ভগত (২৫)। সেই ধারণা থেকেই বাংলাদেশ ঢোকার সময় মানুষ তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটা নিয়ে তিনি একটু অস্বস্তিতে ছিলেন। তবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেই তাঁর সেই ধারণা পাল্টে যায়। এ দেশের প্রকৃতি ও মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ তিনি। আজীবন বাংলাদেশিদের কথা মনে থাকবে তাঁর।
গেল বছরের ১৮ ডিসেম্বর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সাইকেলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন অক্ষয়। ভারতের এই ভূপর্যটক সাইকেল চালিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন। এ ছাড়া সাইকেল চালিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু মহাসড়ক ভারতের উমলিংলা পাসে উঠে রেকর্ড করেন তিনি।
ভূপর্যটক অক্ষয় ভগত সাইকেল চালিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন। এ ছাড়া পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু মহাসড়কে সাইকেল চালিয়ে রেকর্ড করেন তিনি। তাঁর বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বুড়দা গ্রামে। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ তিনি সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করেন।
গত বুধবার রাতে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের ভাটারপাড়া গ্রামে অবস্থান করছিলেন অক্ষয়। ওই গ্রামের বাসিন্দা ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’-এর জেলা কমিটির সভাপতি সুশীল কুমার মাহাতোর বাড়িতে অতিথি হিসেবে আসেন তিনি। ওই রাতেই বাংলাদেশ ও বিশ্বভ্রমণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।
অক্ষয় ভগত শুরুতে আফ্রিকা মহাদেশের চারটি দেশ ভ্রমণের কথা তুলে ধরেন। আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ভ্রমণের কথা তাঁর মনে গেঁথে আছে। দেশটির রাজধানী নাইরোবিতে তাঁর সঙ্গে এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। অক্ষয় ভগত প্রথম আলোকে বলেন, কেনিয়ায় অবস্থানের তৃতীয় দিনে রাতের খাবার খেয়ে সাইকেল চালিয়ে তাঁবুতে ফিরছিলেন তিনি। হঠাৎই তাঁর পথ আটকে দাঁড়ান পাঁচজন যুবক। চারজন তাঁকে জাপটে ধরেন এবং অন্যজন হাতে অস্ত্র নিয়ে সামনে দাঁড়ান। তাঁদের কথামতো পাসপোর্ট ছাড়া সবকিছু তুলে দিতে হয়।
আসার সময় আমার কাছে বেশি সম্পদ ছিল না। কিন্তু এ দেশের মানুষ সেটি বুঝতে দেননি। অনেক জায়গায় বিক্রেতারা আমার কাছ থেকে টাকা নেননি। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন শহরের মানুষের কথা কোনো দিন ভুলব না।ভূপর্যটক অক্ষয় ভগত
সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল জানিয়ে অক্ষয় বলেন, ‘এরপরও সেখানে মাসখানেক ছিলাম। সেখানকার সাধারণ মানুষের ভালোবাসা মনে গেঁথে আছে। সেখানেও উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছি। বিশেষ করে মাসাইমারায় মাসাই উপজাতির কথা ভোলার নয়। তাঁদের সংস্কৃতির বাহারি রূপে মুগ্ধ আমি। পাশাপাশি জিরাফ, হরিণসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী আমাকে মোহিত করেছে। মানুষের সঙ্গে বন্য প্রাণীর এমন সহজ বসবাস অন্য কোথাও দেখিনি।’
উগান্ডায় নীল নদের উৎসমুখ দেখতে গিয়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখেছেন অক্ষয়। বলেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ভয়ংকর সুন্দর। সবচেয়ে বেশি সুন্দর এসব দেশের মানুষ ও তাঁদের সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে অক্ষয় বলেন, ‘আমার দেশের পতাকাসহ সাইকেল নিয়ে এ দেশে প্রবেশের পর দেশের প্রকৃতি ও মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হই। প্রথমে আমাকে হিন্দিভাষী ভেবে অনেকেই আমার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলা শুরু করেন। আসার সময় আমার কাছে বেশি সম্পদ ছিল না। কিন্তু এ দেশের মানুষ সেটি বুঝতে দেননি। অনেক জায়গায় বিক্রেতারা আমার কাছ থেকে টাকা নেননি। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন শহরের মানুষের কথা কোনো দিন ভুলব না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজধানী মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য খুবই সুন্দর।’
তবে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতেই তীব্র যানজটের সম্মুখীন হয়ে বিড়ম্বনায় পড়ার কথা জানান তিনি। ঢাকায় নিজের ব্যবহৃত ক্যামেরাটি হারিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। তবে মানুষের ভালোবাসায় সেই দুঃখ দূর হয়ে যায় অল্প সময়েই। ফেরার পথে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দেশীগ্রাম ইউনিয়নের ভাটারপাড়ায় সুন্দর সময় কাটে তাঁর। বলেন, ‘এখানকার মানুষের কথা ভুলে যাওয়ার নয়।’
বিশ্বভ্রমণের সময় তিনি বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ও সেসব দেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন। পরিবেশ ও নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে গাছ লাগানোর বার্তা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করছেন তিনি। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশে আসেন। ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন। ভাষার প্রতি এ দেশের মানুষের মমত্ববোধ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি।
অক্ষয় ভগতের বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বুড়দা গ্রামে। ছোটবেলা থেকে সাইকেলে ঘোরার নেশা তাঁর। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ নিজের দেশ ঘোরা শুরু করেন তিনি। ১ বছর ১ মাস ৬ দিনে অক্ষয় পুরো ভারত ভ্রমণ করেন। সর্বোচ্চ সাইকেল চালিয়ে গিনেস বুকে নাম লেখান। এরপর তিনি আফ্রিকার চারটি দেশ ভ্রমণ করেন সাইকেলে।
রায়গঞ্জের নিমগাছী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জীব কুমার মাহাতো বলেন, ‘অল্প সময়ে অক্ষয় আমাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশে যান। তাঁর স্বপ্ন পূরণে সামান্য অংশ হতে পেরে এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আনন্দ প্রকাশ করেছেন।’ মাহাতোদের কুড়মালি ভাষার লেখক উজ্জ্বল মাহাতো বলেন, ‘অক্ষয় ভগতের এমন ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমরা আলোকিত হওয়ার সুযোগ পাব।’