ম্যানগ্রোভ বনের গাছ উজাড় করে নিষিদ্ধ গোপজালে নির্বিচারে মাছ শিকার

ম্যানগ্রোভ বনের গাছ উজাড় করে এভাবেই নদীতে সারি সারি খুঁটি বসিয়ে গোপজাল পাতা হচ্ছে। ১৯ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রাম সংলগ্ন বলেশ্বর নদে
ছবি: প্রথম আলো

বরগুনার পাথরঘাটার নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলে অসাধু জেলেরা দেদার নিষিদ্ধ গোপজাল ব্যবহার শুরু করছেন। এতে পোনা মাছ তো বটেই, উপকূলের তিনটি শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন উজাড় হতে চলেছে। ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ নির্বংশ হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে বিষখালী, বলেশ্বর ও সাগর মোহনাসংলগ্ন প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে ১৫টি চরে অন্তত ৫৮টি গোপজালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ১৫টি চর বন বিভাগের টেংরা, চরদুয়ানী, চরলাঠিমারা, পাথরঘাটা সদর ও হরিণঘাটা বিট এলাকায় পড়েছে।

একেকটি জাল এক থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। জোয়ার এলে জালগুলো টানা হয়, তখন এমন কোনো জলজ প্রাণী নেই, এ জালে আটকায় না। খুব ছোট ফাঁসের নিষিদ্ধ এ জালগুলোকে স্থানীয়ভাবে গোপজাল বা চরগড়া জাল বলা হয়। উপজেলার বিষখালী নদী, বলেশ্বর নদ ও সাগর মোহনায় চরে দীর্ঘ একেকটি জাল দেড় হাজার থেকে তিন হাজার শক্ত খুঁটির মাধ্যমে পাতা থাকে। এই খুঁটির জোগান দিতে হরিণঘাটা, টেংরা ও টুলুর চর—এই তিন শ্বাসমূলীয় বনের গেওয়া আর কেওড়াগাছ নিধন চলছে। এ কাজে বন কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ঘুষ লেনদেনের চক্র গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হরিণঘাটা শ্বাসমূলীয় বনটি প্রায় ১০ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। টেংরা শ্বাসমূলীয় বন ১ হাজার একর, টুলুর চর শ্বাসমূলীয় বন ৩০০ একরজুড়ে বিস্তৃত। এই তিন সংরক্ষিত বন উপকূলকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এসব বনে উদ্ভিদের মধ্যে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ছইলা, গোলপাতা বেশি। আর প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর, বানর, কাঠবিড়ালির দেখা মেলে।

ম্যানগ্রোভ বনের গেওয়া আর কেওড়াগাছ উজাড় করে নদীতে সারি সারি বসানো গোপজালের খুঁটি। ১৯ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রাম সংলগ্ন বলেশ্বর নদে

একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোপজাল পাতছেন মূলত প্রভাবশালী জেলেরা। একটা জালের সঙ্গে ১০-১২ জন জেলে যুক্ত থাকেন। তাঁরা বন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করছেন। একেকটি জাল পাতার পর তুলতে ১-৩ দিন সময় লাগে। একেকটি জালে একবারে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মাছ ওঠে।

বিষখালী নদীর উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণের সাগর মোহনা হয়ে বলেশ্বর নদের উত্তর-পশ্চিম অংশে ১৫টি চর ঘুরে অন্তত ৫৮টি গোপজালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ১৫টি চর হলো টুলুর চর, গোলবুনিয়ার চর, ছোট পাথরঘাটার চর, নীলিমা পয়েন্ট চর, বাদুরতলার চর, জিনতলা চর, হরিণঘাটার চর, লালদিয়ার চর, বুড়িরখাল চর, রূহিতার চর, বিহঙ্গদ্বীপ চর, টেংরার চর, হাজিরখাল চর, জ্ঞানপাড়া চর ও নীলাচল চর।

বিষখালী ও বলেশ্বর নদের আশপাশে এলাকার বাসিন্দারা জানান, হরিণঘাটা বনের দুই পাশে বিষখালী ও বলেশ্বরের তীরে বসবাস করা মানুষজন মূলত মৎস্যজীবী। কিছু মানুষ হরিণঘাটা বন থেকে গেওয়া ও কেওড়াগাছ কেটে বিষখালী, বলেশ্বর ও সাগর মোহনা এলাকায় গোপজালে মাছ ধরেন। ছোট গোপজালও এক কিলোমিটারের কমে হয় না। বড়গুলো তিন কিলোমিটার দীর্ঘ হয়। বড় গোপজালে চার-পাঁচ হাজার খুঁটি ব্যবহার করা হয়। ১০ থেকে ১৫ হাত পরপর ওই খুঁটি ব্যবহার করা হয়। একই নিয়মে ছোট চরগড়া ও গোপজালে দুই-তিন হাজার খুঁটি ব্যবহার করা হয়। তিন থেকে চার মাস পরপর ওই খুঁটি পরিবর্তন করতে হয়। জোয়ার এলে এসব জাল রশির মাধ্যমে টানা হয়, তখন এতে সব ধরনের মাছ ধরা পড়ে।

গোপজালের খুঁটির জন্য হরিণঘাটা শ্বাসমূলীয় বনের গেওয়া গাছ নিধন চলছে। ১৯ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটার চরলাঠিমারা বিট এলাকায়

বলেশ্বর ও এর তীর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাগর মোহনার লালদিয়া থেকে উত্তরে চরদুয়ানী পর্যন্ত নদীর তীর থেকে এমনভাবে গোপজালের খুঁটি গাড়া রয়েছে, নদী থেকে ট্রলার চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তা ছাড়া জোয়ারে যখন খুঁটিগুলো ডুবে যায়, তখন ওই এলাকা থেকে যেকোনো ট্রলার বা নৌকা চলাচলে মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া লালদিয়া থেকে চরদুয়ানী পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের বিশাল এলাকাজুড়ে চরগড়া ও গোপজালে জোয়ারে ঢুকে ভাটায় মারা পড়ছে ছোট ছোট পোনা মাছ।

যে ৫৮টি গোপজালের সন্ধান পেয়েছে প্রথম আলো, সেগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ঘুষ লেনদের মাধ্যমে ১৯টি জাল নিয়ন্ত্রণ করছে পাথরঘাটা সদর বিট। হরিণঘাটা বিটের নিয়ন্ত্রণে ৫টি, চরলাঠিমারা বিটের নিয়ন্ত্রণে ১২টি, টেংরা বিটের নিয়ন্ত্রণে ১৫টি এবং চরদুয়ানী বিটের নিয়ন্ত্রণে ৭টি গোপজাল রয়েছে।

গোপজালে ব্যবহারে জন্য স্তূপ করে রাখা হরিণঘাটা শ্বাসমূলীয় বনের গেওয়া গাছ। ১৯ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটার বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা বিট এলাকায়

জানতে চাইলে বন বিভাগ পাথরঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বনের গাছ কেটে চরগড়া জাল (গোপজাল) ব্যবহার করতে আমরাও দেখছি। তাঁদের বারবার বাধা দিলেও মানছেন না।’ ঘুষ লেনদেনে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে বন বিভাগের কর্মচারী জড়িত থাকার কথা বলেন তিনি। পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. তারিকুল ইসলাম জনবলসংকটে অভিযানের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতায় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিষিদ্ধ গোপজালে প্রতিনিয়ত ইলিশের পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ মারা পড়ছে। এতে সামুদ্রিক মাছের বংশবিস্তার হুমকিসহ প্রতিনিয়ত নিষিদ্ধ জালে পোনা মাছ মারা পড়ছে। বিষয়টি ২২ নভেম্বর উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় উত্থাপন করা হলেও এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বিষয়টি পৃথকভাবে পাথরঘাটা কোস্টগার্ড, পাথরঘাটা মৎস্য দপ্তর ও বন বিভাগকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

বন, পরিবেশ ও পর্যটন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আরিফুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গোপজালে সামুদ্রিক মাছের বংশবিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বনের গাছ উজাড় করে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে।