যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্বে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট এলাকা। রাজঘাটের উত্তর পাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। নদের উত্তর পাশে অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রাম। গ্রামের ভৈরব নদের তীরে গাছগাছালির মধ্যে এক আঙিনায় সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ১১টি শিবমন্দির। প্রতিবছরের মতো এবারও একাদশ শিবমন্দির প্রাঙ্গণে বসেছিল প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। ঢাকঢোল আর কাঁসরের বাজনায় গতকাল সারা দিন মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। চৈত্রসংক্রান্তির এই মেলা এলেই আশপাশের গ্রামগুলোতেও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) দ্বিতীয় খণ্ডে ‘চাঁচড়া রাজবংশ’ নামে একটি অধ্যায় আছে। ওই অধ্যায়ে বর্ণনা অনুযায়ী, চাঁচড়া ছিল যশোর রাজ্যের অন্তর্গত। ১৭৪৫ থেকে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যশোরের চাঁচড়ার রাজা ছিলেন নীলকণ্ঠ রায়। তিনি ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। তখন থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্রসংক্রান্তির পূজায় এই মেলা বসছে। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, ওই হিসাব অনুযায়ী চৈত্রসংক্রান্তির এই মেলা বসছে প্রায় ২৭৪ বছর ধরে। তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে মেলার আয়োজন বন্ধ ছিল। ২০২১ সাল থেকে আবার স্বরূপে ফিরেছে বর্ণিল এই মেলা।
গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণে অবস্থান করে দেখা যায়, চৈত্রের খরতাপ উপেক্ষা করেই মেলায় বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঢল নেমেছিল। মেলায় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানা ধরনের জিনিস বিক্রি হয়েছে মেলায়। এ ছাড়া ছিল মিষ্টি, জিলাপি, চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, খই, বাতাসাসহ বিভিন্ন খাবারের আয়োজন।
দুই ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন ভাটপাড়া গ্রামের গৃহবধূ পাপিয়া দাস (৩৮)। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর মেলায় আসি। মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। মেলা থেকে পাঁপড় ও মিষ্টি কিনেছি।’
আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে মেলায় এসেছেন বাণীপুর গ্রামের আলিম উদ্দিন মোল্লা (৩৭)। তিনি বলেন, ‘২৫ বছর ধরে এই মেলায় আসি। চৈত্রসংক্রান্তির মেলাটি গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মেলা থেকে কিছু গৃহস্থালি পণ্য কিনেছি।’
অভয়নগর চৈত্রসংক্রান্তি পূজা কমিটির সভাপতি শিবায়ন দাস বলেন, ‘প্রচণ্ড গরম। তারপরও এবার চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল।’
একাদশ শিবমন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মিলন কুমার পাল বলেন, এই মন্দিরের বয়স ২৭৪ বছর। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছেন, শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্রসংক্রান্তির পূজায় মেলা হয়ে আসছে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকায় এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশের কয়েক গ্রামের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসেন এই মেলায়। সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে এ মেলা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।