ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেনকে নিয়ে বরিশালের হিজলা উপজেলায় তাঁর নিজ গ্রামে বেশ কয়েক দিন থেকেই কানাঘুষা চলছিল। এ নিয়ে এলাকার লোকজন নানা প্রশ্ন করতেন, জানতে চাইতেন স্বজনদের কাছে। মানুষ মুঠোফোনে ভিডিও দেখে বলতেন, আরাফতের মতো একজনের চেহারা। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, আবার অবিশ্বাসও করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি আরাফাতের এক স্বজন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কাছে এই অভিজ্ঞতার কথা জানান। হত্যাকাণ্ড ও লাশ পোড়ানোর কাজে আরাফাত হোসেনের জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাঁর গ্রামের মানুষ।
আশুলিয়া থানা এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলি করে মানুষ হত্যার পর লাশ ভ্যানে তোলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর আরাফাতের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর পর থেকেই আরাফাতের খোঁজখবর পাচ্ছিলেন না গ্রামের স্বজনেরা। এ নিয়ে ধূম্রজালের মধ্যে ছিলেন গ্রামের লোকজন। আজ শুক্রবার র্যাব-৩ এক খুদে বার্তায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ‘সম্পৃক্ত’ আরাফাতকে গ্রেপ্তারের তথ্য নিশ্চিত করে। তাঁকে ঢাকার আফতাবনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে ওই বার্তায় জানানো হয়।
আরাফাত হোসেন হিজলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের পূর্বকান্দি গ্রামের আরিফ হোসেন সিকদারের ছেলে। আরিফ হোসেন বদরটুনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও হরিনাথপুর ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি। এলাকায় সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি আছে তাঁর।
আরাফাত ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর ৭ সেপ্টেম্বর পূর্বকান্দি গ্রামে আরাফত হোসেনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে তাঁদের সেমিপাকা দোতলা টিনের ঘর থাকলেও সেখানে মূল দরজায় তালা ঝুলছে। বাড়িতে স্বজনদের আরও তিনটি ঘর আছে।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আরাফাত সবার বড়। অবসর গ্রহণের পর আরাফাতের মা–বাবা ঢাকায় থাকতেন। বাড়িতে খুব একটা আসেন না তাঁরা। আরাফাত বদরটুনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে ২০০১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ভূগোল বিষয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন পুলিশে।
আরাফাতের বিষয়ে কথা হয় তাঁর মামাতো ভাইয়ের ছেলে নাসির মুনসির সঙ্গে। একই বাড়িতে ভিন্ন ঘরে বাস তাঁদের। আশুলিয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে নাসির মুনসি বললেন, ‘ভিডিওতে যা দেখেছি, এটা সত্যি হলে, ঘটনাটি খুবই নিষ্ঠুর, পাশবিক কাজ হয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, অনেক সময় চাকরির সুবাদে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক নির্মম কাজও করতে হয়। জানি না কী পরিস্থিতিতে তিনি এমন কাজ করেছেন।’
ওই বাড়ির বাসিন্দা ও সম্পর্কে আরাফাতের নানি সুফিয়া বেগম বলেন, ‘আরাফাত আমাগো ধারে আরজু নামে পরিচিত। ছোটবেলা হইতে গোনে আরজুরে (আরাফাত) দেইখ্যা আইছি। কইতে গেলে আমাগো কোলেই বড় হইছে। কিন্তু হ্যারে কোনো দিন খারাপ কাজ করতে দেহি নাই। এহন যা হুনি, খুবই অবাক লাগে, ভিডিওতে যা দেহি, কইতে পারি না, সে এমন কাজ ক্যামনে করল।’
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, মাথায় পুলিশের হেলমেট। সাদা পোশাকের ওপর পুলিশের ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি আরেকজনের সহায়তায় চ্যাংদোলা করে নিথর এক যুবককে দুই হাত ধরে ভ্যানের ওপর তুলছেন। ভ্যানের ওপর আরও কয়েকটি নিথর দেহ স্তূপ করে রাখা। দেহগুলো থেকে ঝরে পড়া রক্তে ভিজে গেছে সড়কের কিছু অংশ। বিছানার চাদরের মতো একটি চাদর দিয়ে তাঁদের ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশেই পুলিশের হেলমেট, ভেস্ট পরা আরও কয়েকজন।
গ্রামের বাসিন্দা নুর মোহম্মদ বলেন, ‘পুলিশের চাকরি নেওয়ার পর আরাফাত গ্রামের বাড়িতে খুব কম আসতেন। তাঁকে জড়িয়ে আশুলিয়া থানা এলাকায় ভ্যানে লাশ ওঠানো নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ, তাঁকে ছোটবেলা থেকে কখনো উগ্র স্বভাবের দেখিনি। তাঁর বাবাও অত্যন্ত সজ্জন ও ভালো মানুষ। পরে ভিডিও দেখে নিজের কাছেই খারাপ লেগেছিল। আরিফ স্যারের ছেলে হয়ে এমন কাজ কীভাবে তিনি করলেন? এমন নৃসংশতায় শুধু এই এলাকার মানুষ নয়; পুরো হিজলা উপজেলার মানুষই লজ্জিত।’