কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার উড়িয়ন্দ গ্রামের কবির মিয়া (২৮) ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি ছিলেন। আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। পরিচয় হয় ভৈরব উপজেলার কালু মিয়ার সঙ্গে। কালু জানান, তাঁর চাচাতো ভাই ফারুক মিয়া লিবিয়ায় থাকেন। তিনি কবিরকে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাবেন। সে আশায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন কালুর হাতে।
কবির মিয়া গত বছরের ১৪ এপ্রিল দেশ ছাড়েন। লিবিয়া যাওয়ার পর কবিরকে নিয়ে একটি ঘরে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে আরও ২০ লাখ টাকা দাবি করে মানব পাচার চক্রের লোকজন। পরিবারের সদস্যরা সর্বস্ব বিক্রি করে ২০ লাখ টাকা পাঠায়। তাতেও কবিরকে তাঁরা ছাড়েননি। পরে কবির কৌশলে পালিয়ে বাঁচেন।
নির্যাতনের ঘটনায় কবিরের বাবার করা মামলার ভিত্তিতে আজ সোমবার সকালে দালাল চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ভৈরব থানা-পুলিশ। তাঁরা হলেন ভৈরব উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের জামালপুর মাইজহাটি গ্রামের কালু মিয়া (৪০), জনুফা বেগম (২৫) ও অনুফা বেগম (৪০)। মানব পাচার আইনে করা এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
কবিরের পরিবারের সদস্য ও থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, দালাল চক্রের প্রধান মাইজহাটি গ্রামের ফারুক মিয়া (৪৫)। তিনি লিবিয়া থাকেন। গ্রেপ্তার কালু মিয়া হলেন ফারুকের চাচাতো ভাই। জনুফা হলেন ফারুকের শ্যালিকা আর অনুফা সম্পর্কে ফুফু হন। তাঁরা ভৈরবে থেকে ফারুককে সহায়তা করেন। বিশেষ করে টাকা লেনদেন হয় তাঁদের মাধ্যমে। এ ছাড়া তাঁরা এলাকার লোকজনকে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দিতেন।
কবিরকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠাবেন—এমন শর্তে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ১৪ এপ্রিল কবির লিবিয়া যান। লিবিয়া যাওয়ার পর শুরু হয় কবিরের ওপর নির্যাতন। ২০ লাখ টাকা ছাড়া মুক্তি এবং ইতালি—দুটির কোনোটি মিলবে না, এমন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে কবিরের পরিবারের লোকজন জমিজমা বেচে কালুর হাতে গত বছরের ১৩ নভেম্বর টাকা দেন। তাতেও কবিরকে মুক্তি দিচ্ছিলেন না চক্রের সদস্যরা। শেষে গত বছরের জুন মাসে কবির কৌশলে পালিয়ে যান। পরে আরেক ব্যক্তির মাধ্যমে ইতালি যান তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রোববার রাতে ভৈরব থানায় ফারুককে প্রধান আসামি করে মানব পাচার আইনে মামলা করেন কবিরের বাবা আয়ুব আলী। মামলা হওয়ার পর পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে।
আয়ুব আলী বলেন, চক্রটির সদস্যদের মুখের কথা খুব মিষ্টি। মিষ্টি কথায় সরলভাবে বিশ্বাস করেছিলেন। চক্রের সদস্যরা নির্যাতন করে তাঁর ছেলের এক পা ভেঙে ফেলেছে। সেই দৃশ্য ভিডিও করে তাঁর কাছে পাঠায়। বাবা হিসেবে এই দৃশ্য দেখা কঠিন। পরে আর কিছু না ভেবে ভিটেমাটি বিক্রি করে তাঁদের টাকা পরিশোধ করেন।
কিন্তু এত দিন পরে কেন এ ঘটনায় মামলা করলেন? এর জবাবে আয়ুব বলেন, মামলা করা হলে কবিরের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে বলে চক্রের সদস্যরা তাঁদের হুমকি দিয়েছিলেন। তখন বাধ্য হয়ে নীরব ছিলেন। কবির ইতালি গেছে শুনে তাঁদের আবার হুমকি দেওয়া হয়, ইতালিতেও তাঁদের লোক আছে। বাড়াবাড়ি করলে ইতালিতেও কবিরের ক্ষতি হবে। এই ভয়ে মামলা করতে সময় লেগে যায়।
থানা হেফাজতে থাকা কালু মিয়া বলেন, ‘ফারুক আমাদের ব্যবহার করেছে। আমরা বিষয়টি বুঝতে পারিনি। এই টাকার ভাগ আমরা কেউ পাইনি।’
ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম বলেন, গ্রেপ্তার তিনজনই চক্রের সদস্য। মামলার আরও তিন আসামি আছে। এখন তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে।