শাশুড়িকে মেরে বস্তায় ভরে ফেলে দেন পুত্রবধূ

আদালত
প্রতীকী ছবি

পারিবারিক বিষয় নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে বিরোধ ছিল পুত্রবধূর। সেই বিরোধের জেরে শাশুড়িকে হত্যার পরিকল্পনা করেন পুত্রবধূ। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে খাওয়ানো হয় ঘুমের বড়ি। এরপর তাঁকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় কবরস্থানে। লাশ ফেলে দেওয়ার কাজে সহায়তা করে দুই কিশোর-কিশোরী।

রাজশাহীর পুঠিয়ায় ১২ এপ্রিল বেদেনা বেওয়া নামে এক নারীর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। বেদেনা বেওয়াকে হত্যার অভিযোগে হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার তাঁর পুত্রবধূ কনিকা খাতুন ১৪ এপ্রিল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। পুঠিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বেদেনা বেওয়ার লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে কনিকা খাতুন ও রিপন আলীর প্রথম স্ত্রীর মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরই তাঁরা পুলিশের কাছে বেদেনা বেওয়াকে শ্বাসরোধে হত্যার কথা স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে ওসি সাইদুর রহমান বলেন, বেদেনা বেওয়ার পুত্রবধূ কনিকা খাতুন তাঁকে শ্বাস রোধ করে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার অভিযোগে পুলিশ বেদেনা বেওয়ার এক নাতি ও এক নাতনিকে গ্রেপ্তার করেছে।

খুন হওয়া বেদেনা বেওয়া (৫৭) পুঠিয়া উপজেলার থান্দারপাড়ার মোজাহার আলীর স্ত্রী। মোজাহার প্রায় ৩৩ বছর আগে মারা গেছেন। বেদেনার এক ছেলে ও মেয়ে। কনিকা খাতুন তাঁর ছেলে রিপন আলীর স্ত্রী। এই ঘটনায় রিপন আলীর প্রথম স্ত্রীর মেয়ে (১৪) এবং চাচাতো ভাই জুয়েলের ছেলেকে (১৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুঠিয়া থানার ওসি বলেন, কনিকার বাবার বাড়ি জেলার চারঘাট উপজেলায়। আট বছর আগে রিপনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বেদেনা বেওয়াকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করার সময় রিপন আলী বাইরে ছিলেন। তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। বেদেনা বেওয়ার লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে কনিকা খাতুন ও রিপন আলীর প্রথম স্ত্রীর মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরই তাঁরা পুলিশের কাছে বেদেনা বেওয়াকে শ্বাসরোধে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে ১৪ এপ্রিল কনিকা খাতুন ও বেদেনার নাতনি রাজশাহীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

পুঠিয়া থানার ওসি সাইদুর রহমান আদালতে দেওয়া কনিকা খাতুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলেন, শাশুড়ির সঙ্গে কনিকার মনোমালিন্য ছিল। এ নিয়ে ঘটনার দিন (৯ এপ্রিল) তাঁর সঙ্গে ঝগড়াও হয়েছিল। এর জেরে তিনি তাঁর শাশুড়িকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ইফতারের সময় পরিকল্পনামাফিক তিনি শরবতের সঙ্গে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে রিপন আলীর প্রথম স্ত্রীর মেয়েকে বলেন, ‘এই শরবত তোমার দাদিকে দাও।’ কিন্তু প্রথমে ওই মেয়ে তার দাদিকে শরবত দিতে রাজি হয়নি। বলেছে, ‘তুমিই দাও।’ তখন কনিকা বলেছেন, তার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, তিনি দিলে খাবেন না। তখন ওই মেয়ে তার দাদির হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দেয়। দাদি শরবত পানের পরপরই ঘুমিয়ে পড়েন।

এরপর কনিকা বালিশচাপা দিয়ে বেদেনা বেওয়াকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেন। পরে তিনি তাঁর চাচাতো দেবর জুয়েলের ছেলেকে ডাকেন। তিনি তাকে প্রথমে কেক খেতে দেন। তারপর তিনি তার সহযোগিতা চান। কনিকা, রিপন আলীর প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ও কনিকার চাচাতো দেবরের ছেলে মিলে বেদেনা বেওয়ার লাশটি বস্তায় ভরে দেয়ালের ওপর দিয়ে পাশের কবরস্থানে ফেলে দেয়।

পুলিশের সূত্র জানায়, ১২ এপ্রিল গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় এক ব্যক্তি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশকে খবর দেন। এরপর পুঠিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে একটি বস্তা পড়ে থাকতে দেখে। তীব্র দুর্গন্ধের কারণে পুলিশ ঘটনাস্থলে ডোম ডেকে আনে। এরপর ডোম এসে বস্তার মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেদেনা বেওয়ার লাশ বের হয়ে আসে। পরদিন পুলিশ রিপন ও তাঁর স্ত্রী কনিকাকে থানায় মামলা করার জন্য ডাকে। তাঁরা থানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিপন ও তাঁর স্ত্রীকে আলাদা জায়গায় নিয়ে পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কনিকা তাঁর শাশুড়িকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে তাঁর দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে বাড়ি থেকে রিপন আলীর মেয়েকেও থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর রিপন আলী তাঁর মাকে হত্যার অভিযোগে পুঠিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। তাদের দুজনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। তারা দুজনেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

বেদেনা বেওয়া হত্যা মামলায় আজ পুলিশ রিপন আলীর চাচাতো ভাই জুয়েলের ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সেও ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তাকেও আদালতে সোপর্দ করা হয়।

মামলার বাদী ও বেদেনা বেওয়ার ছেলে রিপন আলী লাশ উদ্ধারের দিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। ৯ এপ্রিল বাসায় এসে জানতে পারেন তাঁর মা বাড়ি থেকে একটু দূরে বানেশ্বর বাজারে গেছেন। বাজার থেকে তাঁর ভাগনেকে আনতে যাওয়ার কথা বলে যান। পরে ভাগনে একাই বাড়িতে এসেছে, কিন্তু মা ফেরেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে মাকে না পেয়ে ১১ এপ্রিল পুঠিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

রিপন আরও বলেছিলেন, যে কবরস্থানে তাঁর মায়ের লাশ পাওয়া গেছে, সেটি তাঁর বাসার একদম পাশেই। বৃহস্পতিবার ঈদের নামাজ শেষে কবরস্থানে অনেকে কবর জিয়ারত করতে গেছেন। কিন্তু তখন সেখানে কোনো লাশ ছিল না। শুক্রবার দুপুরের পর গন্ধ পেয়ে স্থানীয় লোকজন সেখানে গিয়ে বস্তাবন্দী লাশ দেখতে পান। থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। তাঁরা গিয়ে তাঁর মায়ের লাশ শনাক্ত করেছেন।