প্রথম ২৫ বছর ছিল তেল পরিবহনকারী ট্যাংকার। শেষ দুই দশক ভাসমান তেল সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এভাবে প্রায় ৪৫ বছরে ‘সাত সাগর তেরো নদী’ পেরিয়ে বিশালাকার ট্যাংকারটির ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সমুদ্র উপকূলে। এটির সর্বশেষ নাম ‘ফার্ন’। গত ২৭ মাসে সীতাকুণ্ডের উপকূলে ভাঙার জন্য আনা এটিই সবচেয়ে বড় ট্যাংকার।
ট্যাংকারটি লম্বায় প্রায় ৩৪৬ মিটার, বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ভবন সিটি সেন্টারের (১৭১ মিটার) দ্বিগুণ। প্রস্থ ৫৭ মিটার। আয়তনে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান। ট্যাংকারটিতে একসঙ্গে ৩ লাখ ২৩ হাজার টন তেল রাখার ক্ষমতা ছিল। তাতে পানির নিচে চলে যেত ট্যাংকারটির পানির ওপরে থাকা ২২ মিটার।
১৯৭৯ সালে পর্তুগালের একটি ইয়ার্ডে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ট্যাংকারটির ৪৫ বছরের পথচলায় বহুবার নাম পরিবর্তন হয়েছে। কখনো বিটি ব্যাংকার, কখনো ফোক সান, কখনো ফার্নান ভাজ নামে সাগরে দাপিয়ে চলেছে। আবার আফ্রিকার গ্যাবন কিংবা গিনি বিসাউর মতো দেশের পতাকার নামে চলেছিল জাহাজটি। সর্বশেষ বাংলাদেশে আসার আগে সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নিবন্ধনে রয়েছে ট্যাংকারটি।
কয়েক দফা হাতবদল শেষে সংযুক্ত আরব আমিরাতের লাস্ট ভয়েস ডিএমসিসি থেকে এটি কিনেছে সীতাকুণ্ডের এসএন করপোরেশন। এটি ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, ট্যাংকারটি ভেঙে পাওয়া যাবে ৪২ হাজার টন লোহা। প্রায় দুই কোটি ছয় লাখ ডলারে ট্যাংকারটি আমদানি করা হয়েছে। শুল্কায়ন মূল্য ও শুল্ককরসহ ট্যাংকারটি দাম পড়েছে প্রায় ২৪৯ কোটি টাকা। এটি ছাড়া চলতি অর্থবছরে বড় জাহাজ আমদানি হয়েছে একটি। মোস্তফা হাকিম গ্রুপের এইচএম শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির নামে আমদানি হওয়া ওই জাহাজ ভেঙে পাওয়া যাবে ৪১ হাজার ৩৭৪ টন লোহা। এই দুটি ছাড়া চলতি অর্থবছরে আর কোনো বড় জাহাজ আমদানি হয়নি। গত দুই বছরে ডলার-সংকটে ঋণপত্র খুলতে কড়াকড়ির কারণে সীতাকুণ্ড উপকূলে বড় জাহাজের আমদানি কমেছে। এমন সময়ে এ ধরনের বড় জাহাজ আমদানি এই খাতের ব্যবসায়ীদের নজর কেড়েছে।
এ ধরনের বড় জাহাজ ভাঙতে কেমন সময় লাগে, জানতে চাইলে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ হাজার টনের বেশি লোহা আছে, এমন বড় জাহাজ ভাঙতে কম করে হলেও ছয় মাস সময় লাগে। গত এপ্রিলে আমদানির পর আমাদের ৪১ হাজার টনের জাহাজটির মাত্র ২০ শতাংশ ভাঙা হয়েছে।’
তিনি জানান, দুই বছর আগে ৪০ হাজার টনের বেশি লোহা আছে, এমন জাহাজ বছরে আমদানি হতো ১২ থেকে ১৪টি। এখন এই সংখ্যা কম। কারণ, জাহাজভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ভাঙার জন্য বিশ্বজুড়ে বড় জাহাজের সরবরাহ কমেছে। আবার বড় জাহাজ আমদানির ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের ২০ জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এবার ১৬২টি জাহাজ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে, যেগুলোয় গড়ে ১০ হাজার টনের কম লোহা রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬২টি জাহাজে রয়েছে ৯ লাখ ৭৯ হাজার টন লোহা, যা গত দুই দশকে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন আমদানির পরিমাণ। এর আগে সর্বনিম্ন আমদানি ছিল গত অর্থবছরে। তখন ১৪৭টি জাহাজ আমদানি হয়, যেগুলোয় লোহা ছিল ৯ লাখ ৭১ হাজার টন।
উদ্যোক্তারা জানান, একেকটি পুরোনো জাহাজ থেকে হাজার রকমের পণ্য পাওয়া যায়। রড তৈরির কাঁচামাল লোহার টুকরো, অভ্যন্তরীণ নৌযান তৈরির জন্য পুরোনো জাহাজের প্লেট, বাতিল যন্ত্রাংশ, জেনারেটর ও যন্ত্রপাতি, নাটবল্টু, আসবাব, রান্নাঘরের হরেক জিনিস মেলে। অর্থাৎ লৌহ ও ইস্পাতশিল্প, নৌযানশিল্পের কাঁচামাল যেমন আছে, তেমনি গৃহস্থালি ও কারখানায় ব্যবহার্য নানা পণ্যও রয়েছে। এগুলোকে ঘিরে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বাজার গড়ে উঠেছে। আমদানি কমে যাওয়ায় এসব খাতে ব্যস্ততাও কমেছে।