‘আমরা গরিব মানুষ। রাজনীতি বুজি না। বুজি খালি পেটনীতি। তাই ছেড়াডারে ১৫ বছর বয়সে কামে লাগাইছলাম। ছেড়ার কামাইয়ে আমার সংসারডা বালা মতে চলত। আমার কামাইসুদ (কর্মক্ষম) ছেড়াডারে গুলি কইরা মাইরালছে। এতে কার কী লাভ অইছে, জানি না। আমার কিন্তু বড় ক্ষতি অইয়া গেছে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলেছেন শহীদুল ইসলাম (৬৫)। তিনি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার জাহাঙ্গীপুর ইউনিয়নের পূর্ব দেউলডাংরা গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামে ছোট একটি মুদিদোকান চালান তিনি। চার ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা শহীদুল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২১ জুলাই তাঁর ছোট ছেলে জামান মিয়া (১৭) নরসিংদীর তানিয়া ডাইং কারখানার সামনের সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর (২৫ জুলাই) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে মারা যায়। পুলিশ সে দিনই হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত করে পরিবারের কাছে জামানের লাশ হস্তান্তর করে। পরে বাড়িতে এনে লাশ দাফন করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নান্দাইলের পূর্ব দেউলডাংরা গ্রামে জামানদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানহারা মা মিনারা বেগম উঠানে বসে কাঁদছিলেন। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আফনেরা কি আমার ছেড়াডারে ফিরাইয়া দিতাইন পারবাইন? কইনছেন, আমার ছেড়াডারে পক্ষীর মতো গুলি কইরা মাইরা কার কী লাভ অইছে? আমারে সন্তানহারা কইরা দেশের কোন বালাডা অইছে?’ এসব কথা বলতে বলতে সন্তানের নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
নিহত জামান গত কোরবানির ঈদে বাড়িতে এসেছিল। সাত দিন থেকেছিল। আদরযত্ন করে খাইয়েছেন মা। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের দিনও মুঠোফোনে ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে জানান মিনারা বেগম। নরসিংদীতে গন্ডগোলের কথা জানিয়েছিল সে। তিনি ছেলেকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। তখন সে ভালো আছে বলে মাকে জানিয়েছিল। পরদিনই ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেলেন।
চার ভাইয়ের সবাই ছোটবেলা থেকে কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন বলে জানান নিহত জামানের বড়ভাই রায়হান মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামানকে আমি কোলে কাঁধে নিয়ে বড় করেছি। অথচ এই কাঁধে করে তাকে কবরে নামিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, জামান দুবছর আগে নরসিংদী সদরের তানিয়া ডাইংয়ে (কাপড়ের কারখানা) কাজ নেয়। কারখানার কাছাকাছি একটি মেসে থাকত সে। ২১ জুলাই জামান মেস থেকে খেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারখানার উদ্দেশে রওনা হয়। সড়ক পার হয়ে কারখানার ফটকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। দুটি গুলি তাঁর পেটের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এ অবস্থায় সে প্রায় দেড় ঘণ্টা সড়কে পড়ে ছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পুলিশ বা সাধারণ মানুষ—কেউ এগিয়ে যায়নি। পরে খবর পেয়ে নরসিংদীতে অবস্থানরত আত্মীয়–স্বজনেরা জামানকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার কোনো চিকিৎসা হয়নি। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের চার দিন পর গত ২৫ জুলাই সকালে জামান না ফেরার দেশে চলে যায়।
রায়হান একপর্যায়ে নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘আমার কিশোর ভাইটিকে যারা মেরেছে তাদের কঠোর বিচার চাই আমরা। এ পর্যন্ত কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। মানুষ মারলে বিচার হবে না, এ কেমন দেশে বাস করছি আমরা?’