সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের ইফতার মাহফিল। ১৫ মার্চ তোলা
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের ইফতার মাহফিল। ১৫ মার্চ তোলা

প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন যেখানে

প্রতিদিন শিঙাড়া, কলা, চিড়া, ছোলা, ফিরনি, খেজুর, ডিম—এই সাত রকম পদ থাকে। এখন প্রতিদিন ইফতারি করাতে ব্যয় হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা।

একসঙ্গে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের ইফতার আয়োজন। মাঠে বিশাল শামিয়ানা টাঙানো। নিচেই কাতারে কাতারে বসা মানুষ। তাঁদের সামনে স্বেচ্ছাসেবকেরা পৌঁছে দিচ্ছেন ইফতারি। রমজানে এক মাস ধরে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন বিনা পয়সায় রোজদারদের ইফতারি করানোর জন্য এ আয়োজন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মিশন কর্তৃপক্ষের দাবি, এটিই দেশের সর্ববৃহৎ ইফতার মাহফিল।

আহ্ছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৩৫ সালে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র.) নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকে তিনি প্রতিবছরই রমজানে মাসব্যাপী এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। প্রথম অবস্থায় স্বল্প পরিসরে কয়েকজনকে নিয়ে তিনি মিশন মসজিদে এ আয়োজন করতেন। পরে কলেবর বাড়তে থাকলে ইফতারির আয়োজন করতেন মিশন চত্বরে। তাঁর মৃত্যুর পরও মিশন কর্তৃপক্ষ এ আয়োজন চালু রেখেছে। রমজানের শুরু থেকেই প্রতিদিন এখানে একত্র হয়ে ইফতার করছেন বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ।

ইফতারির সার্বিক দায়িত্বে থাকা মাসুম বিল্লাহ জানায়, করোনার আগে একসঙ্গে ১০ হাজার মানুষের আয়োজন করা হতো। ছয় হাজার মানুষ নলতা কেন্দ্রীয় আহ্‌ছানিয়া মাঠে বসে ইফতারি করতেন। আর চার হাজার রোজাদারের জন্য সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলা, খুলনা ও যশোরের ঝিকরগাছায় ইফতারি সরবরাহ করা হতো। কিন্তু করোনার পর মিশনের বাইরে ইফতারি সরবরাহ করা হচ্ছে না নানাবিধ কারণে।

নলতা আহছানিয়া মিশনের প্রধান হিসাবরক্ষক মো. এবাদুল হক জানান, বর্তমানে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এ আয়োজন সফল করার জন্য প্রতিবছর রোজার ৪০ দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। রোজাদারদের বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষা করতে তৈরি করা হয় বিশাল অস্থায়ী ছাউনি। এ বছর ছাউনি বানাতে খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার কিছু বেশি। ইফতারি বিলিবণ্টন ও তদারকির জন্য রয়েছেন চার শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। প্রতিদিন শিঙাড়া, কলা, চিড়া, ছোলা, ফিরনি, খেজুর, ডিম—এই সাত রকম পদ থাকে। এখন প্রতিদিন ইফতারি করাতে ব্যয় হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা।

গত ১৫ মার্চ বেলা ১১টায় দিকে নলতা রওজা শরিফ প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, ৩০ জন কর্মচারী ফিরনি, শিঙাড়া, ছোলা ভুনা ও ডিম সেদ্ধ করছেন। আবার কেউ কলা ও খেজুর বাছাই করছেন। কয়েকজন গ্লাস-প্লেট পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত। আবার অনেকে রোজাদারদের বসার স্থান প্রস্তুত করছেন।

বাবুর্চি মহব্বত আলী ও মোক্তার আলী জানান, তাঁরা দুজন ৩৮ বছর ধরে এখানে ইফতারি তৈরির কাজ করছেন। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ফিরনি তৈরি শুরু করেন। বর্তমানে ৫০০ কেজি দুধ দিয়ে ফিরনি প্রস্তুত করা হয়। সেদ্ধ করা হয় সাড়ে পাঁচ হাজার ডিম। ২৫০ কেজি ছোলা ভিজানো হয়। এ ছাড়া ১০৮ কেজি সুজি, ময়দা ১৯০ কেজি, চিড়া ১৫০ কেজি, চিনি ১৫০ কেজি, কয়েক মণ আলু দিয়ে থাকে।

ফিরনি ও ডিম সেদ্ধ করার কাজটি করেন মহব্বত আলী। তাঁর সঙ্গে আরও রয়েছেন ছয়জন সহযোগী। তিনি বলেন, ‘আমরা এ মাসে রোজাদারদের খেদমত করি তৃপ্তি পাই। কর্তৃপক্ষ যে টাকা দেয়, তাতে সবাই খুশি থাকেন। এটা পারিশ্রমিক নয়, সম্মানী।’

 এই মিশনে ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। সবাই এসেছেন নিজ উদ্যোগে। বেলা সাড়ে তিনটার পর থেকে কাজ বণ্টন শুরু করা হয়। একজন স্বেচ্ছাসেবক আবদুর রহমান জানালেন, তাঁরা চেষ্টা করেন, যাতে ইফতার করতে আসা রোজাদারদের কোনো অসুবিধা না হয়। প্রথমে ছাউনির নিচে মাদুর বিছানো হয়। তারপর সারি সারি লাইন করে পানির বোতল দেওয়া হয়। তারপর গ্লাস-প্লেট। বিকেল সাড়ে চারটার দিক থেকে প্লেটে প্লেটে দেওয়া হয় ইফতারি। সাড়ে পাঁচটার দিকে ইফতার মাহফিল তৈরি হয় জনসমুদ্রে।

ওই দিন যশোরের থেকে রফিকুল ইসলাম ইফতার করতে আসেন। তিনি বলেন, নলতা শরিফে একসঙ্গে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন। তাই সবার সঙ্গে ইফতারে যোগ দিতে তিনিসহ এলাকার ১৭ জন এসেছেন। তিনি নলতা পীর সাহেবের ভক্ত।

একই কথা জানালেন আফজাল হোসেন ও কামরুল ইসলাম। তাঁরা এসেছেন ঢাকার গুলশান থেকে। বলেন, এত মানুষ একসঙ্গে ইফতারি করার যে কর্মযজ্ঞ, তা না দেখলে বিশ্বাস হতো না।