রাজশাহী বিভাগে বিভিন্ন খাদ্যগুদামে সাত লাখ খালি বস্তা সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও বস্তা সরবরাহ করেনি।
আবার যেগুলো সরবরাহ করেছে, সেগুলো নিম্নমানের। আমন ২০২৪-২৫ সংগ্রহ সফল করার লক্ষ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল খাদ্য অধিদপ্তর। বস্তা সরবরাহে অনিয়ম হওয়ায় সংগ্রহ ব্যাহত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর খাদ্যগুদামের বস্তার তদন্ত হলেও কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, এই অনিয়মের সঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত। তাই অন্য গুদামগুলোর বস্তার গুণগতমান যাচাইয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি।
খাদ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী, সরবরাহযোগ্য বস্তার ওজন ৩৩০ গ্রাম হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগের দুটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ব্যাপারে জানা গেছে। তাদের একটি মেসার্স হারুণ অ্যান্ড সন্স এবং অন্যটি মেসার্স সিয়াম টেক্সটাইল অ্যান্ড জুট।
খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা গেছে, মেসার্স হারুণ অ্যান্ড সন্সের বস্তার ওজন গড়ে প্রায় ৪০ গ্রাম ও সিয়ামের গড়ে প্রায় ৫০ গ্রাম। দরপত্রের মূল্যে প্রতিটি বস্তা ৫৩ টাকার ঊর্ধ্বে হলেও সিয়াম টেক্সটাইলের ১৫ টাকা মূল্যের পুরোনো বস্তা সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া ৩০ টাকা মূল্যের কম ওজনের কিছু নতুন বস্তা দিচ্ছে। নতুন বস্তা সরবরাহের স্থলে বেশ কিছু স্টেনসিলযুক্ত ব্যবহৃত বস্তা, উল্টিয়ে ব্যবহৃত বস্তা ও বিভিন্ন মিলের নামসংবলিত বস্তা সরবরাহ করা হচ্ছে।
মেসার্স হারুন অ্যান্ড সন্স রাজশাহী বিভাগের গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর খাদ্যগুদামে ৫০ হাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা খাদ্যগুদামে আড়াই লাখ, রহনপুর খাদ্যগুদামে এক লাখ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর খাদ্যগুদামে দুই লাখ খালি বস্তা সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। ২৯ ডিসেম্বর বস্তা সরবরাহের শেষ দিন ছিল। কিন্তু তারা শুধু রহনপুরে এক লাখ বস্তা সরবরাহ করেছে। সেগুলোও বেলবিহীন ঢিলা ও নিম্নমানের।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা খাদ্যগুদাম প্রায় দুই মাস আগে সিয়াম টেক্সটাইলের থেকে ৩০ কেজি ধারণক্ষম ১ লাখ খালি বস্তা গ্রহণ করে। এর মধ্যে ২৪ হাজার বস্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর গুদামে পাঠানো হয়। সেখানে দেখা যায়, বস্তাগুলো নিম্নমানের। বস্তার ওজন ৩৩০ গ্রামের স্থলে ২৮০ গ্রাম। অধিকাংশই স্টেনসিলযুক্ত ব্যবহৃত বস্তা, উল্টিয়ে ব্যবহৃত বস্তা ও বিভিন্ন মিলের নাম লেখা। নিম্নমানের বস্তার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু নিম্নমানের বাকি ৭৬ হাজার বস্তা নির্বিঘ্নে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ বিলও পরিশোধ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে আমনুরা গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেশমা ইয়াসমিন শুধু বলেন, মালগুলো সঠিক নয়। তিনি এ ব্যাপারে জেলা বস্তা গ্রহণ কমিটির আহ্বায়কের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে বস্তা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সিয়াম টেক্সটাইল অ্যান্ড জুটের ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে কল করলে অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি বলেন, তিনি সিয়ামের সাবেক কর্মচারী। এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর গুদামে সরবরাহ করা ১ লাখ বস্তার অধিকাংশই নিম্নমানের ও কম ওজনের হওয়ায় কমিটির সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করেননি। অথচ এ বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। প্রত্যয়নপত্রে সই না করার ব্যাপারে গ্রহণ কমিটির সদস্য ও রহনপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বাইরে ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বস্তা না দেখিয়ে সই করার জন্য চাপাচাপি করছিলেন। কিন্তু তিনি না দেখে সই করেননি।
এদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর খাদ্যগুদামের বস্তা না পাওয়ার ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজুমল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁর গুদামে মেসার্স হারুণ অ্যান্ড সন্সের ৩০ কেজি ধারণক্ষম ৫০ হাজার বস্তা দেওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত তাঁকে সেই বস্তা সরবরাহ করা হয়নি।
এ বিষয়ে হারুণ অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারীর ছেলে ফয়সাল রশিদ তাঁদের ঢাকা কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলতে বলেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবেন না।
যোগাযোগ করলে খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকেন হারুণ অ্যান্ড সন্স যদি বস্তা না দিয়ে থাকে, সেটা তাদের লোকসান। সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। তারা মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে। আমরা জরিমানা করে মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছি। না দিলে তারা কালো-তালিকাভুক্ত হবে। তাদের জামানত ১৬ লাখ টাকা বাজেয়াপ্ত হবে।’
আমনুরায় নিম্নমানের বস্তা সরবরাহের ব্যাপারে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে একটি তদন্ত কমিটি গেছে। তারা এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। প্রতিবেদন পাওয়ার আগে তো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। প্রতিবেদনের জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কমিটি যদি বলে ভুলক্রমে দিয়েছে, তাহলে বদলাইয়ে দেবে। আর যদি বলে ইচ্ছা করেই দিয়েছে, তাহলে কালো তালিকাভুক্ত হবে। আর যারা ওই বস্তা গ্রহণ করেছে, তাঁদের শাস্তিমূলক বদলি ও বিভাগীয় মামলা হবে।’