জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট হিমাগারে বীজ আলুর মজুদ। গত সোমবারে তোলা
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট হিমাগারে বীজ আলুর মজুদ। গত সোমবারে তোলা

জয়পুরহাটে বীজ আলুর কৃত্তিম সংকট, টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা

জয়পুরহাটে মৌসুম শুরুর আগেই বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এভাবে কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তাঁদের দোকান ও গুদামে বীজ আলু রাখছেন না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে মণপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি রেখে অজ্ঞাত স্থান থেকে কৃষকের কাছে বীজ আলু পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা।

বেশি দামে বীজ আলু বিক্রির অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। তবে কৃষকেরা বলছেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে লোকদেখানো জরিমানা ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বীজ আলুর সংকটের অজুহাতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও খাবার উপযোগী আলু বিভিন্ন কোম্পানির মোড়কে প্যাকেটজাত করছেন। এসব নিম্নমানের বীজ আলু কিনে কৃষকদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

এ বিষয়ে জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক আফরোজা আকতার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বীজ আলু বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় বাজার তদারক করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জয়পুরহাটে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে ৬০ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর চাহিদা আছে। এখনো আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শেষ হয়নি। এ কারণে পুরোদমে আলুর চাষ শুরু হয়নি। বাজারে যে পরিমাণ বীজ আলুর সরবরাহ আছে, তাতে কোনো সংকট থাকার কথা নয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ১১টি কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা জয়পুরহাট জেলায় উচ্চফলনশীল বীজ আলু সরবরাহ করছেন। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এই ১১ কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা মোট ২২ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়া ১৯টি হিমাগারে কৃষকদের কাছে আরও প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু আছে।

চলতি মৌসুমে জয়পুরহাটে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে ৬০ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর চাহিদা আছে।

জেলার মধ্যে কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আলুর চাষ হয়। এ তিন উপজেলার ৬০ থেকে ৭০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, বিএডিসি, ব্র্যাক, এসিআই, ইস্পাহানি ও সুপ্রিম কোম্পানির বীজ আলুর চাহিদা বেশি। ব্র্যাকের ‘এ’ গ্রেডের বীজ আলুর মণ ৩ হাজার ২০০ ও ‘বি’ গ্রেডের মণ ৩ হাজার ১২০ টাকা। তবে ব্র্যাকসহ অন্যান্য কোম্পানির বীজ আলু খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব খুচরা ব্যবসায়ীকে নির্ধারিত দামের চেয়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি দিলে তাঁরা বীজ আলু জোগাড় করে দিচ্ছেন। দোকানিরা বেশি দাম নিলেও তাঁরা কৃষকদের কোনো রসিদ দিচ্ছেন না।

আক্কেলপুর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এলাকার কৃষক ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘ব্র্যাকের ১০ বস্তা বীজ আলুর জন্য ৭ দিন খুচরা দোকানে ঘুরেও পাইনি। ওই বীজ আলু কেউই নির্ধারিত দামে কিনতে পারেননি। আমাদের এখানে গোপনে ব্র্যাকের বীজ আলু ৪ হাজার ৭০০ থেকে ৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ভোরে ও রাতে ভ্যানযোগে বীজ আলু পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এবার বীজ আলুর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেছে।’

কালাইয়ে বীজ আলুর দাম বেশি নেওয়ায় দুই ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে। ওই দুই ডিলারের ডিলারশিপ বাতিলের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকি অব্যাহত আছে।
মেহেদী হাসান, জয়পুরহাটের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা

আক্কেলপুর কলেজ বাজারের খুচরা বীজ ব্যবসায়ী ভাই ভাই ট্রেডার্সের মালিক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি চলতি মৌসুমে ডিলারের কাছে ৬০০ বস্তা ব্র্যাকের বীজ আলুর চাহিদা দিয়েছিলাম। এ পর্যন্ত ডিলার আমাকে ৩৬৩ বস্তা বীজ আলু দিয়েছে।’ তিনি নির্ধারিত দামে বীজ আলু বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেন।

ডিলার গোলাম রব্বানী বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বীজ আলুর সরবরাহ কম। এ কারণে চাহিদামতো বীজ আলু সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

তবে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দামে বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ব্র্যাক সিডের টেরিটরি সেলস কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, জয়পুরহাট জেলায় ১৪ জন ডিলার আছে। ডিলাররা ১৫ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর চাহিদা দিয়েছিলেন। এরই বিপরীতে ৬ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন বীজ আলু সরবরাহ করা হয়েছে। ‘বি’ গ্রেডের বীজ আলুর খুচরা মূল্য ৩ হাজার ১২০ টাকা ও ‘এ’ গ্রেড বীজ আলুর দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা।

জয়পুরহাটের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বীজ আলুর বাজার তদারক করছি। স্থানীয় প্রশাসন বাজার তদারকিতে সহযোগিতা করছে। কালাইয়ে বীজ আলুর দাম বেশি নেওয়ায় দুই ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে। ওই দুই ডিলারের ডিলারশিপ বাতিলের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকি অব্যাহত আছে।’