ছেলে হারানোর শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নূর মোহাম্মদের মা রুমা খাতুন (বাঁয়ে)। শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়
ছেলে হারানোর শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নূর মোহাম্মদের মা রুমা খাতুন (বাঁয়ে)। শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়

‘কেমনে পোলাডারে গুল্লি কইরা মাইরা লাইলো’

‘পোলাডা মারা যাওয়ার এক দিন আগে ফোন কইরা কইছিল, আমারে আর ঢাকা থাকা লাগব না। খুব তাড়াতাড়ি মুন্সিগঞ্জে লইয়া আইব। আমার যত ধারদেনা আছে, সব কাজ কইরা শোধ কইরা দিব। সবাইরে লইয়া এক লগে, এক বাড়িতে থাকব। আমার হেই পোলাডারে কেমনে গুল্লি কইরা মাইরা লাইলো।’ বিলাপ করতে করতে গত শুক্রবার এসব কথা বলছিলেন রুমা খাতুন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত নূর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদারের (১৯) মা।

নিহত নূর মোহাম্মদ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সিরাজুল সরদারের ছেলে। তবে তিনি মুন্সিগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে ভাড়ায় অটোরিকশা চালাতেন। ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় আন্দোলন চলাকালে গুলিতে তিনি মারা যান।

পরিবার ধারদেনায় জর্জরিত হলে নূর মোহাম্মদের মা রুমা খাতুন ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। আর তাঁর বাবা সিরাজুল ইসলাম শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়ি চলে যান। নূর মোহাম্মদের দুই ভাই ও দুই বোন উত্তর ইসলামপুরে নানি শেফালী বেগমের সঙ্গে থাকেন।

গত শুক্রবার মুন্সিগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকায় নিহত নূর মোহাম্মদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ঘরে স্বজনেরা আহাজারি করছেন। আশপাশের লোকজন তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নূর মোহাম্মদের মা রুমা খাতুন বলেন, ‘অভাবের সংসারে যখন নূর মোহাম্মদ হইল, তহন নিজেরাই খাইতে পারতাম না। ওরে পালক দিতে চাইছিলাম। আমার মা দিতে দেয় নাই। পরে আমি ঢাকায় যাই। ওর নানি ওরে মাইনষের বাড়িতে কাজ কইরা খাওয়াইয়া বড় করছে। অভাবের কারণে পোলাডারে নিজের কাছে রাখতে পারি নাই।’

নূর মোহাম্মদকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন স্বজনেরা। শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের উত্তর ইসলামপুর এলাকায়

স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ৪ আগস্ট সকাল থেকে মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তাঁরা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় গেলে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের পেটাতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা বন্দুক, ছুরি, ককটেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে নূর মোহাম্মদসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী রহমতুল্লাহ বলেন, বাড়িতে কাজের কথা বলে এলেও নূর মোহাম্মদ সকাল থেকেই তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁদের ধাওয়া দেন। তাঁদের ওপর ককটেল ও গুলি ছোড়া হয়। নূর মোহাম্মদ তাঁদের পেছনে ছিলেন। একপর্যায়ে উত্তর ইসলামপুর গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েন তাঁরা। হঠাৎ একটি গুলির শব্দ পান। পরক্ষণে দেখেন নূর মোহাম্মদ কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কয়েকজন তাঁকে ধরাধরি করে একটি বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান। পাঁচ মিনিট পরেই নূর মোহাম্মদ মারা যান।

নূর মোহাম্মদের বোন বৈশাখী আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। আমার ভাই দেশের জন্য মরেছে। ভাই হারানোর কষ্ট আছে। তবে ভাইয়ের জন্য গর্ববোধ করি। যারা আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।’