জাহানারা বেগম (৭৮) পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাঁর এক হাত ও এক পা অচল; স্বামী-সন্তান নেই। তারপরও গতকাল বৃহস্পতিবার ঈদের দিনটি জাহানারা বেগমের আনন্দেই কেটেছে। চার মাস ধরে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন। এখানেই তিনি ঈদ উদযাপন করেছেন।
জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে প্রথম ঈদ করছি। এ রকম আদর–ভালোবাসা গত ৩০ বছরে পাইনি। আমার স্বামী-সন্তান নেই তো কী হয়েছে! আমার অনেকগুলো বাবা (বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধানকারী) আছে। বাবারা থাকতে ঈদ খারাপ কাটার সুযোগ নেই। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, বাকি দিনগুলোও যেন এ রকম সুখে কেটে যায়।’
আমার স্বামী-সন্তান নেই তো কী হয়েছে! আমার অনেকগুলো বাবা (বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধানকারী) আছে। বাবারা থাকতে ঈদ খারাপ কাটার সুযোগ নেই।জাহানারা বেগম, বৃদ্ধাশ্রমের নিবাসী
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসভার শেখপাড়ায় ওই বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানার অবস্থান। এটি পরিচালনা করছে ‘অসহায় বন্ধুদের ঠিকানা ফাউন্ডেশন’। যেসব বয়স্ক নারীর ভরণপোষণের কেউ নেই, তাঁদের এই বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হয়। বর্তমানে দুজন বৃদ্ধা রয়েছেন। আর এতিমখানায় রয়েছে ২৬টি শিশু।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রমের একটি কক্ষে চারটি খাট। একটি খাটে নতুন কাপড় পরে বসে রয়েছেন জাহানারা বেগম। পাশেই ক্রাচ। জাহানারা বেগমের বাড়ি ভোলা জেলার গজারিয়া এলাকায়। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ৩৫ বছর আগে মারা যান। এরপর তিনি চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় এক ব্যক্তির বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। জাহানারা বেগম জানান, দুই বছর আগে হঠাৎ একদিন মাথা চক্কর দিয়ে তিনি পড়ে যান। ধীরে ধীরে তাঁর ডান হাত ও ডান পা অচল হয়ে যায়। চার মাস আগে এই বৃদ্ধাশ্রমে তাঁকে পাঠিয়ে দেয় ওই পরিবার।
জাহানারা বেগম বলেন, ‘এখানে এসে অনেক ছেলে পেয়েছি। একেকজন একেক সময় দেখতে আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে সময় কেটে যায়। তারা ওষুধ, খাবার, কাপড়চোপড় সব দেয়। এখানে কোনো অভাব নেই।’
ওই কক্ষে আরেক খাটে রয়েছেন আসবা বেগম (৮০)। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। তাঁর স্বামী শহিদুল হক ১৯৭২ সালে মারা যান। ছোট থাকতেই এক ছেলে মারা যায়। আরেক ছেলে আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন। পাঁচ বছর আগে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
আসবা বেগম বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পর বউ চলে যায় তার বাপের বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনদের এ বাড়ি–ও বাড়ি দিন কাটাতাম। চার মাস আগে এখানে আসি। এখন খুব ভালো আছি। দিন কেটে যাচ্ছে। আমার দুই ছেলে হারিয়েছি কিন্তু অনেক ছেলে পেয়েছি।’
বৃদ্ধাদের দেখাশোনা করেন ছানোয়ারা বেগম নামের এক নারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকালে গোসল করে নতুন কাপড় পরে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন দুই বৃদ্ধা। এরপর সেমাই আর নুডলস খেয়েছেন। দুজন মিলে সারা দিন গল্প করেন। একজন অন্যজনের সহায়তা নিয়ে চলাফেরা করেন।
‘অসহায় বন্ধুদের ঠিকানা ফাউন্ডেশন’–এর পরিচালক আবু তাহের গতকাল বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। এ সময় তিনি ওই দুই বৃদ্ধার খোঁজখবর নেন। করোনার সময় মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের খাবার দিতেন আবু তাহের। তাঁকে নিয়ে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল ‘মানসিক প্রতিবন্ধীদের রোজ খাবার দিচ্ছেন তাহের’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তায় অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছি। গত চার বছরে অন্তত ৩৫ জন নাম–পরিচয়হীন মানুষকে উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে ১১ জনের ঠিকানা পেয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেছি। বাকি ২৪ জনকে দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। এরপর স্বজনহীন নারীদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম করার বিষয়টি মাথায় আসে।’
টিনশেড ঘরে বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানা গড়ে উঠেছে। তবে এর পেছনে চার শতক জমির ওপর তৈরি হচ্ছে চারতলা ভবন। আবু তাহের জানান, বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণে দানশীল মানুষ সাহায্য করছেন। স্থানীয় কামরুদ্দোজা নামের একজন প্রকৌশলী চার শতক জমি দান করেছেন। দুজনকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রম চালু হয়েছে। পাশাপাশি ২৬ জন এতিম শিশুকে নিয়ে চালু হয়েছে এতিমখানা। ধীরে ধীরে তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে।