স্কুল করতে নিজে জমি দিয়েছেন। অন্যের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে বেড়া দিয়ে তৈরি করেছেন স্কুলঘর। প্রথম সাত বছর পারিশ্রমিক ছাড়াই তিনি ছাত্রদের পড়িয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের কেউ এখন বিচারক, কেউ–বা সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। দীর্ঘ ৩০ বছর ৯ মাস ২২ দিন শিক্ষকতার পর আজ বৃহস্পতিবার অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বিদায় নেন। তাঁর বিদায়বেলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মহান এই শিক্ষকের নাম গৌর চন্দ্র ঘোষ। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বেজপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর সহকর্মীরা বলছেন, শিক্ষক গৌর চন্দ্রের বিদায়ে তাঁরা একজন সৎ ও কর্মিষ্ঠ সহকর্মী হারালেন। দীর্ঘ তিন দশক চাকরির সময় শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি তিনি বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়েরও হিসাব রেখেছেন। কখনো তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষটিকে হারিয়ে তাঁরা মর্মাহত।
গৌর চন্দ্র ঘোষ কালীগঞ্জ উপজেলার বেজপাড়া গ্রামের মৃত রবীন্দ্রনাথ ঘোষের ছেলে। তিনি ১৯৯৫ সালে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের অচীন কুমার ঘোষের মেয়ে সবিতা রানী ঘোষকে বিয়ে করেন। বর্তমানে তাঁদের সংসারে বড় ছেলে উৎপল কুমার ঘোষ ও মেয়ে স্বর্ণা রানী ঘোষ আছেন। ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন আর মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছেন।
গৌর চন্দ্র ঘোষ জানান, নিজ এলাকায় স্কুল না থাকায় তিনি যশোরের হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে যশোরের কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি ও যশোর সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নেন নিজ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন। ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যদের সঙ্গে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে নেমে পড়েন। নিজে ১৯ শতক জমি দান করেন, অন্যরাও কিছু জমি দিয়েছেন। সবাই মিলে বাঁশ কেটে ঘর বানিয়ে ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তৈরি করেন বেজপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঠদান শুরু করেন। সেই থেকে তিনি বাংলার শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেন।
শিক্ষক গৌর চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সেই প্রতিষ্ঠানের তিনটি ভবন হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ আছে সাতটি। দুটি অফিসকক্ষ, দুটি কমন রুম। দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে তাঁর ছাত্র বিচারক, নৌবাহিনীর কর্মকর্তা হয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল হলেও সেখান থেকে অনেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ৩০ বছর ৯ মাস ২২ দিন চাকরি শেষে আজ বিদায় নিলেন ওই শিক্ষক। ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁরা বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও ২০০০ সাল পর্যন্ত বেতন পাননি। ২০০০ সালে প্রথম মাত্র ২ হাজার ১০০ টাকা বেতন পান শিক্ষক গৌর চন্দ্র ঘোষ। পরে পর্যায়ক্রমে বেতন বেড়েছে। তিনি বলেন, একজন শিক্ষানুরাগী ও নম্রভদ্র মানুষ তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নিলেন।
ওই শিক্ষকের বিদায়ের কথা শুনে ছুটে আসেন গৌর চন্দ্রের একসময়ের সহকর্মী জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসা. আক্তার জাহান ও চাঁচড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু আলম। আক্তার জাহান বলেন, শিক্ষক হিসেবে গৌর চন্দ্র খুবই ভালো। পাশাপাশি তিনি সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। বিদ্যালয়ের একটি টাকাও তাঁর হাতে কখনো নষ্ট হয়নি।
বিদায়ের সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ মাহমুদ, সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. রাশেদুজ্জামানসহ অন্য শিক্ষক-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বিদায়ী শিক্ষককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেন। প্রধান শিক্ষক ফিরোজ মাহমুদ জানান, তাঁরা আগামী ১৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানে বড় করে বিদায় অনুষ্ঠান করবেন।