মৌলভীবাজারে বিএনপি বিভক্ত নাসের–মিজানুরে, আওয়ামী লীগ অনেকটাই গোছানো

আওয়ামী লীগ অনেকটাই গোছানো। কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সবাই একসঙ্গে দলের কার্যক্রম, সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। চলছে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও।

মাঝেমধ্যে একসঙ্গে দুজনকে একমঞ্চে বসতে ও বক্তৃতা করতে দেখা যায়। কিন্তু কার্যত বছর দুই ধরে তাঁরা একসঙ্গে নেই। আন্দোলন-কর্মসূচি সবই চলছে, তবে তা আলাদা। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে এভাবেই চলছে মৌলভীবাজারে জেলা বিএনপির কার্যক্রম।

অন্যদিকে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ মৌলভীবাজারে অনেকটাই গোছানো অবস্থায় আছে। বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সবাই একসঙ্গে দলের কার্যক্রম, সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। চলছে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিও। ভেতরে ভেতরে নেতৃত্ব ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নেতাদের পছন্দ-অপছন্দ থাকলেও প্রকাশ্যে কোনো বিরোধের কথা শোনা যায় না।

বিএনপিতে দুই মেরুতে সভাপতি ও সম্পাদক

২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রের অনুমোদন পায়। সভাপতি হন প্রয়াত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের বড় ছেলে এম নাসের রহমান। সাধারণ সম্পাদকের পদে আসেন সাবেক ছাত্রদল নেতা মিজানুর রহমান। শুরুতে দুজনের নেতৃত্বে সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। এর মধ্যে করোনার সময়ে দলীয় কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে শুরু হয় দুই নেতার দ্বন্দ্ব। নাসের রহমানের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে একক সিদ্ধান্তে মৌলভীবাজার পৌর কমিটি গঠন, কমিটি থেকে বিভিন্নজনকে বাদ দেওয়া, কাউকে পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন মিজানুর রহমান।

এর পর থেকে তিনি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন অংশ আলাদা কর্মসূচি পালন শুরু করে। বর্তমানে দলের প্রায় সব কর্মসূচিই হচ্ছে পৃথকভাবে। সংগঠনের কার্যালয় না থাকায় নাসের রহমানের নেতৃত্বাধীন নেতা-কর্মীরা তাঁর গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার বাহারমর্দানে এবং মিজানুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নেতা-কর্মীরা শহরের চৌমোহনা এলাকার একটি মার্কেটের একটি কক্ষে বসেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ১৯ নভেম্বর সিলেট বিভাগীয় মহাসমাবেশেও দুই পক্ষ আলাদাভাবে অংশ নেয়। এই দূরত্ব ঘোচাতে গত বছরের ১ ডিসেম্বর কেন্দ্রের আহ্বানে জেলা বিএনপির এক বিশেষ সভা হয়। সেখানে দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরাই অংশ নেন। কিন্তু একই ছাদের নিচের এ অবস্থান বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দুই পক্ষই আবারও আলাদাভাবে দলের কর্মসূচি পালন করছে।

জেলা পর্যায়ের এই বিভক্তির ছায়া পড়েছে উপজেলায়ও। সাতটি উপজেলার মধ্যে অন্তত চারটিতে কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি আলাদাভাবে কর্মসূচি হয়ে থাকে। তিনটি উপজেলায় এককভাবে দলীয় কার্যক্রম চলছে। ২১ সেপ্টেম্বর সিলেট মহাসড়কে বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে পথসভা হয়। সেখানে জেলা বিএনপির দুই পক্ষ একসঙ্গে অংশ নেয়। পথসভায় সভাপতিত্ব করেন এম নাসের রহমান। সঞ্চালনা করেন মিজানুর রহমান। এই পথসভা আশা তৈরি করলেও বাস্তবে দূরত্ব ঘোচেনি বলে মনে করেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

সভাপতির অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত জেলা বিএনপির প্রথম যুগ্ম সম্পাদক মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এক দফার আন্দোলন চলছে। ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধ থাকলে একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করতাম।’

দুই বছর ধরে আলাদা কার্যক্রম পরিচালনার কথা স্বীকার করে মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সভাপতি একক সিদ্ধান্তে যখন যা ইচ্ছা করেন। এই কমিটি ভাঙেন, এই কমিটি গড়েন। সব উপজেলাতেই এর প্রভাব আছে। সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘সেন্ট্রালের (কেন্দ্রের) হস্তক্ষেপে এক মঞ্চে শুধু প্রোগ্রাম (রোডমার্চের পথসভা) হয়েছে। এর আগে বর্ধিত সভাও একসঙ্গে হয়েছিল। এখন দেখি কী হয়।’

এম নাসের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের স্বার্থে আমার সদিচ্ছায় তাঁকে (সাধারণ সম্পাদক) পথসভায় একসঙ্গে অ্যালাউ করেছি। দলের স্বার্থে অনেক কিছু ছাড় দিয়েছি। কেন্দ্রীয় নেতারাও খুশি হয়েছেন। কিন্তু তাঁর অভিযোগ কিসের? সভাপতি হিসেবে আমার নির্বাচনী এলাকায় যাকে খুশি তাকে নেতা বানাব। আমার কমিটি আমার ইচ্ছেমতো হবে। তাঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই দলের জন্য ঠিক আছেন। সমস্যা তাঁকে নিয়ে।’

দলের কোন্দল নিয়ে হতাশা আছে তৃণমূল নেতা–কর্মীদের মধ্যেও। তাঁরা বলছেন, নেতাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব, বিভিন্ন অবিশ্বাস কাজ করছে। কেন্দ্রও দায়িত্ব নিয়ে সমাধান করছে না। এরই মধ্যে জেলা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।

নাসের রহমান বলেন, কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। উপজেলা সম্মেলন শেষ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক থাকলে অক্টোবরের শেষের দিকে জেলা সম্মেলন করার চিন্তা আছে।

বিএনপির বিভক্ত রাজনীতির প্রভাব আছে সহযোগী সংগঠনেও। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বিএনপির কর্মসূচিতে এসে ভাগ হয়ে যান। যুবদল ও ছাত্রদল জেলা কমিটির মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আগামী সংসদ নির্বাচনে কারা কোথায় প্রার্থী হবেন, ভেতরে ভেতরে সেই মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, এখন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি নিয়ে আন্দোলন চলছে। দল আন্দোলনে আছে। নির্বাচনী কোনো তৎপরতা নেই।

ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মৌলভীবাজার-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নেছার আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক হন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতীতে দলের মধ্যে অনেকটা প্রকাশ্যেই বিরোধ ছিল। বর্তমান কমিটি গঠনের পর প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ দেখা যায়নি। এরই মধ্যে তিন বছরের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালিত হচ্ছে।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যে রকম বিরোধ ছিল। এখন তা নেই। আমরা মিলেমিশে আছি।’ একই কথা বলেন আরেক যুগ্ম সম্পাদক ও মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয়ভাবে আসনভিত্তিক নির্বাচনের কাজ শুরু করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিত সভা করে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করা হচ্ছে। বর্তমান সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এলাকায় তৎপরতাও শুরু করেছেন।

জেলার সাতটি উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের হালনাগাদ কমিটি আছে। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সম্প্রতি জেলা যুবলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ জেলা কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন হয়েছে ২৪ সেপ্টেম্বর।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দলীয় কর্মসূচির পাশাপাশি আগামী নির্বাচনভিত্তিক কাজ করছি। জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও কেন্দ্র থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। জেলা সম্মেলনের তারিখ কেন্দ্র নির্ধারণ করে। এ পর্যন্ত চিঠি দেয়নি। আগামী নির্বাচনের পর জেলা সম্মেলন করা হবে।’

বর্তমানে জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) ছাড়া বাকি তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তবে চারটি আসনেই আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী তৎপরতা শুরু করেছেন।

মৌলভীবাজার-১ আসনে (বড়লেখা–জুড়ী) বর্তমান সংসদ সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের পাশাপাশি আরও দুজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর কথা শোনা গেছে। মৌলভীবাজার-৩ (রাজনগর-সদর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নেছার আহমদের পাশাপাশি আরও তিনজন মনোনয়ন চাইতে পারেন। মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনে সংসদ সদস্য হচ্ছেন মো. আবদুস শহীদ। এই আসনে আরও একজনের নাম প্রচারে আছে।

মৌলভীবাজার-২ আসনে সংসদ সদস্য গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। এই আসনে বিভিন্ন সময় জোটের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করেন, এই আসন আওয়ামী লীগের। দলের কাউকে মনোনয়ন দিয়ে আসনটি ফিরে পেতে চাইছেন তাঁরা। এখানে আওয়ামী লীগ থেকে অন্তত চারজন মনোনয়ন চান।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বড় দল। কারও পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। পাঁচ বছর ধরে সহযোগী সংগঠনেও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নেই। আমরা ঐক্যবদ্ধতা ধরে রাখতে পেরেছি।’