নিহত ছেলের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাঁদেন ফোরকান বিবি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুর জেলা পরিষদ মিলনায়তননে
নিহত ছেলের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাঁদেন ফোরকান বিবি। আজ মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুর জেলা পরিষদ মিলনায়তননে

কারও হাতে, কারও পায়ে গুলির চিহ্ন, কেউ কাঁদছিলেন হারানো স্বজনের জন্য

স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে ওয়াহিদ ছিলেন ষাটোর্ধ্ব ফোরকান বিবির আশা-ভরসা। ওয়াহিদ চাকরি করতেন একটি পোশাক কারখানায়। মাস শেষে যে আয়, তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলত মা-ছেলের। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে গুলিতে মারা যান ওয়াহিদ। সেই সঙ্গে নিঃস্ব হন ফোরকান বিবি।

আজ মঙ্গলবার গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ফোরকান বিবি। সেখানে তাঁকে ছেলের বিষয়ে কিছু বলতে বলা হয় তাঁকে। মাইক্রোফোন হাতে নিতেই অশ্রুশিক্ত হয়ে ওঠেন ফোরকান বিবি। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘মাইয়্যাডারে বিয়া দেওয়ার পর ছেলেডাই আসিল একমাত্র ভরসা। এহন ছেলে নাই, তাই আমারেও দেখার কেই নাই। কী খাই, কই থাকি,Ñকেউ খবর রাখে না।’

‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদের স্মরণে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে’ এই স্মরণসভার আয়োজন করে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। গাজীপুর জেলা পরিষদ কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সভায় উপস্থিত ছিলেন গণ–অভ্যুত্থানে গাজীপুর মহানগর এলাকার আহত ব্যক্তি ও নিহত মানুষের স্বজন বা পরিবারের লোকজন। অনুষ্ঠানে তাঁদের খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা।

বেলা দুইটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো মিলনায়তন মানুষে ভরা। এর মধ্যে অধিকাংশই গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তি। তাঁদের কারও হাত, পা, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলির ক্ষতচিহ্ন। কারও গুলিতে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউবা এসেছেন হাত-পা ভাঙা নিয়ে। সামনের সারিতে ছিলেন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।

আহত ব্যক্তিদের একজন গাজীপুরের বাঘের বাজার এলাকার তারা মিয়া। তাঁর ডান পায়ে এখনো ক্ষতচিহ্ন। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। তিনি জানান, গত ৫ আগস্ট আরও মানুষজনের সঙ্গে বিজয় মিছিল নিয়ে বাঘের বাজার থেকে শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় যান। সেখান থেকে ফেরার পথে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। তারা মিয়া বলেন, ‘আমি একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতাম। গুলি খেয়ে অসুস্থ হওয়ার আমার চাকরিডা চইল্যা যায়। এখন ঘরে বেকার বইস্যা আছি। সংসার খরচ নিয়া খুব বেকায়দায় পইড়্যা গেছি। ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ারও ট্যাকা নাই।’

অনুষ্ঠানে গাজীপুরের সিভিল সার্জন মাহমুদা আখতার বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাবিষয়ক যেকোনো পরামর্শ বা সেবা দিতে আমরা সিভিল সার্জন প্রশাসন প্রস্তুত আছি, তা ছাড়া আমরা সব সময়ই যাঁরা আহত ব্যক্তি বা তাঁদের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছি। এ ব্যাপারে সব রকম সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

অনুষ্ঠান শেষে কথা হয় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের হেলথ কো-অর্ডিনেটর নিশাত আহমেদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানের বিভিন্ন সময় গাজীপুর থেকে মোট ১৮ জন শহীদ হয়েছেন। পাশাপাশি আহত হয়েছেন ৩৭৫ জন। আজ আমরা সেসব আহত ব্যক্তি ও শহীদ পরিবারের খোঁজখবর নিতে স্মরণসভার আয়োজন করেছি। তাঁদের চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যাপারে যা যা করণীয়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছি। পাশাপাশি তাঁরাও আমাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।’

সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর মহানগর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার হাসিবুর রহমান।

অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন, তাঁদের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা নিহত ব্যক্তিদের পরিবার বা আহত ব্যক্তিদের পাশে সব সময় আছি।’