তাজরীন ফ্যাশনসের পরিত্যক্ত ভবনটির দেয়ালে এখনো আছে সেই দিনের আগুনের লেলিহান শিখার চিহ্ন ও ভয়াবহতার ছাপ। আজ রোববার সকালে ভবনটির নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় দেখা হলো, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সন্তানহারা মা শাহেরা খাতুনের সঙ্গে। ভবনে লেগে থাকা সেই দিনের ক্ষত চিহ্ন দেখছিলেন, আর বিলাপ করে শাহেরা বলছিলেন, ‘ও শাহ আলম রে, আমার বাপ রে, আমার বাপের খুনিদের বিচার কবে হবে রে?’
আজ ২৪ নভেম্বর তাজরীন ট্র্যাজেডির এক যুগপূর্তি। এ উপলক্ষে আজ সকাল থেকে ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড নামে ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন আরও অনেকে। এ ঘটনার ১২ বছর পূর্তিতে নিহত শ্রমিকদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ভেঙে আহত শ্রমিকদের বাসস্থান, শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ, নিহত ব্যক্তিদের এক জীবনে আয়ের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। সেই সঙ্গে তাঁরা আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য দায়ী মালিকসহ অন্যদের বিচার নিশ্চিত করা দাবি তোলেন।
প্রতিবছর ভবনের মূল ফটকে তালা লাগানো থাকায় ফটকের সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হতো। তবে এবার ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা ফটকের তালা ভেঙে ঢুকে ভবনটির নিচতলায় ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। এই কর্মসূচিতে অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন শাহেরা খাতুন। তাঁর বড় ছেলে শাহ আলম তাজরীন ট্র্যাজেডিতে মারা যান।
আলাপকালে শাহেরা খাতুন জানালেন, আশুলিয়ার ইয়ারপুরে তাঁদের বাড়ি। তাঁর বড় ছেলে শাহ আলম তাজরীন ফ্যাশনস ভবনের চতুর্থ তলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। সে দিনের অগ্নিকাণ্ডে তাঁর ছেলে মারা গেছেন। তিনি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।
আহত শ্রমিক নাসিমা আক্তার বলেন, ‘সে দিনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সবাই ভুলতে পারলেও আমরা ভুলতে পারব না। সেদিনের কষ্ট, যন্ত্রণা ও বেদনা আমরা এখনো টের পাই। এখন আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কাজ করতে পারি না। কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চলছে।’
নাসিমা আক্তার জানান, কাজ করার জন্য ঢাকায় এসে তিনি এখন পঙ্গু। অর্থনীতির চাকা তাঁরাই ঘোরান। কিন্তু তাঁদের এখন সংসার চলে না। এই সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তাঁদের দাবি পূরণ করবেন, এটাই এখন প্রত্যাশা করেন।
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অরবিন্দ ব্যাপারী বলেন, বিগত সরকার শ্রমিক হত্যার বিচার করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার বিভাগ শ্রমিক হত্যায় দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করবে, এটাই তাঁদের প্রত্যাশা। সুষ্ঠু তদন্ত করে আহত শ্রমিক ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা যাঁরা ক্ষতিপূরণ পাননি, তাঁদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, গার্মেন্টস শিল্প আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী চলে। এ কনভেনশন অনুযায়ী একজন শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা, তাঁর সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ। কিন্তু সেটি পাচ্ছেন না। তাজরীন ট্র্যাজেডির পর ভবনটি জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু এখানে গ্যারেজ হিসেবে কে বা কারা যেন ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন।
খায়রুল মামুন বলেন, ২০১২ সালে তাজরীন ও ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর সরকার ইআইএস প্রকল্প চালু করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অন্তর্ভুক্ত কারখানাগুলো ২০২২ সালের জুন মাস থেকে যারা কারখানায় দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হবেন, তাঁরা পেনশন আকারে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে দুটি কারখানার শ্রমিকদের কারণে এই প্রকল্প চালু হলো, তাঁদের বাদ পড়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। তাঁদেরসহ অন্যান্য কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের এই প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে। দ্রুত দাবি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।