পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনে নানা অসংগতি

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক লেনদেনে নানা অসংগতি ও অনিয়ম ধরা পড়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে নিরীক্ষা (অডিট) আপত্তি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ২০২২-২৩ নিরীক্ষাবছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবসংক্রান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়। জানা গেছে, নিরীক্ষা দল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি আর্থিক লেনদেনের ওপর নিরীক্ষা চালিয়েছে। প্রতিটি লেনদেনেই অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, গাড়ির জ্বালানি ক্রয় ও বই কেনাসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের উপপরিচালক ফারুক হোসেন চৌধুরী বলেন, আপত্তিটি সাবেক উপাচার্যের আমলের। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেবে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এই অর্থবছরে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে অতিরিক্ত ব্যয় হয় ২ কোটি ৯০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত এই অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে কোনো জবাব দিতে পারেননি। ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

‘পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প’ নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে একাধিক বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ছিল ২৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। দুই অর্থবছরে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। একইভাবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করায় চুক্তিমূল্য বৃদ্ধি করে ২৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নিরীক্ষা আপত্তি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটি সাংবাদিকদের জানার কথা নয়। যাঁরা নিরীক্ষা করেছেন, তাঁরা বিষয়টি তাঁদের জানিয়েছেন। তাঁরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জি এম আজিজুর রহমান, পরিচালক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প

প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন সরবরাহ ও পূর্তকাজ বাস্তবায়নের জন্য দুই কিস্তিতে ৬০ কোটি টাকা দিয়েছে। এ টাকা প্রকল্পের কাজে না লাগিয়ে অন্য দুটি ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সেখান থেকে চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি অব্যয়িত অর্থ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এড়ানোর জন্য এ অনিয়ম করা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের হিসাব নম্বর থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে গাড়ির জ্বালানি, গ্যাস ও লুবরিকেন্ট কেনার নামে ৩৭ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিধি অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। অন্যদিকে ২০২১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা সুদ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা সম্মানী, আপ্যায়ন ও যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণের নামে ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এ টাকা অন্য খাতে ব্যয়ের কোনো বিধান নেই। তাই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সব টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পে শিক্ষক কর্মকর্তা ক্লাবের জন্য তিনতলা ভবন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু ভবনটি দোতলা করে ৯৬ লাখ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ওয়াটার বডি ও কেন্দ্রীয় পানিনিষ্কাশনের জন্য ৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা ধরা থাকলেও বাস্তবে কোনো কাজ করা হয়নি।

প্রকল্পের আসবাব কেনার ক্ষেত্রেও কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্মুক্ত দরপত্র (ওটিএম) পদ্ধতির পরিবর্তে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পের অধীন ছাপা কাজের একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। কার্যাদেশ দেওয়া হয় প্রিয়াংকা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। কার্যাদেশের চুক্তিমূল্য ছিল ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। একইভাবে কনসালটেন্সি বা পরামর্শের জন্য ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২ কোটি ৫১ লাখ টাকার একটি চুক্তি করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে নিরীক্ষা আপত্তি গ্রহণ করলেও কোনো জবাব দিতে পারেননি। ফলে এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পে শিক্ষক কর্মকর্তা ক্লাবের জন্য তিনতলা ভবন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু ভবনটি দোতলা করে ৯৬ লাখ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ওয়াটার বডি ও কেন্দ্রীয় পানিনিষ্কাশনের জন্য ৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা ধরা থাকলেও বাস্তবে কোনো কাজ করা হয়নি। দোতলা আনসার ক্যাম্প ভবন করার কথা থাকলেও করা হয়েছে একতলা ভবন। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৯ লাখ টাকা। এ বিষয়েও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দিতে পারেনি।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জি এম আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নিরীক্ষা আপত্তি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটি সাংবাদিকদের জানার কথা নয়। যাঁরা নিরীক্ষা করেছেন, তাঁরা বিষয়টি তাঁদের জানিয়েছেন। তাঁরা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এরপরও যদি কোনো বিষয় থাকে, তবে সরকারের টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে।

প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২০ থেকে ২০২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পদ ছাড়াই অর্গানোগ্রাম–বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ভাতা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করলেও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিয়ে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব টাকাও বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

অনিয়ম হয়েছে বই কেনা নিয়েও। ২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিনটি বিভাগের জন্য ১২ কোটি ১৫ লাখ টাকার বই কিনতে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নিম্নমানের বই সরবরাহ করায় বই গ্রহণ কমিটি তা নেয়নি। বইগুলো প্রকল্প পরিচালক অফিসের গুদামে পড়ে আছে। নিরীক্ষাকালে বইগুলো বুঝে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। বইগুলো বুঝে নেওয়া হলেও পুরো টাকাই অপচয় হবে বলে নিরীক্ষা দল মনে করে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত গ্রন্থাগারিক হাফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিছু বই ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু বই ফেরত পাঠানো হয়েছে। ঠিকাদার ভালো মানের বই দিলে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাফিজা খাতুন বলেন, ‘বিষয়টি আমি যোগদানের আগের ঘটনা। আমার সময় কোনো অনিয়ম বা অডিট (নিরীক্ষা) আপত্তি হয়নি। তবে অডিট আসলে সব সময় কিছু না কিছু আপত্তি তুলে ধরে পরামর্শ দেয়। আমরা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তীকালে কাজ করার চেষ্টা করব।’