বাল্যবিবাহ বেআইনি ও ক্ষতিকর জানার পরও মানুষ এটা সমর্থন করেন

বরিশালে নারী- শিশুর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচারণা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাল্যবিবাহকে ‘লালকার্ড’দেখাচ্ছেন অতিথিরা। বৃহস্পিতবার দুপুরে বরিশাল সার্কিট হাউস মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশালে নারীশিশুর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ‌‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ সময় তাঁরা নারীশিশুদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করার দাবি জানান এবং যেকোনো মূল্যে বাল্যবিবাহকে সমর্থন না করে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নেন।

নারীশিশুর প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বরিশাল বিভাগীয় পর্যায়ের মাল্টিমিডিয়া প্রচারণার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এ আয়োজন করা হয়। বরিশাল সার্কিট হাউস মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। এতে বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও উন্নয়নকর্মী, শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবক, নারীনেত্রী, শিক্ষক, গণমাধ্যমের কর্মী এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশ নেন।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে ‘এক্সিলারেটিং প্রটেকশন ফর চিলড্রেন (এপিসি)’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় বরিশাল বিভাগে এ প্রচারণা শুরু হয়েছে।

সকাল ১০টায় সার্কিট হাউস মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী। সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও এপিসি প্রকল্পের পরিচালক এস এম লতিফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরিশাল রেঞ্জের উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মঞ্জুর মোরশেদ, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সোহরাব হোসেন। বক্তব্য দেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম, বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি) উপমা ফারিসা, ইউনিসেফের বরিশাল আঞ্চলিক প্রধান আনোয়ার হোসেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মেহেরুন্নাহার।

অনুষ্ঠানে দেশের শিশুর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি নিয়ে ইউনিসেফের করা একটি সমীক্ষা তুলে ধরা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা সঞ্জিত কুমার দাস এটি উপস্থাপন করেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৩০ শতাংশ শিক্ষিত মানুষ জানেন বাল্যবিবাহ বেআইনি ও ক্ষতিকর। কিন্তু এরপরও তাঁরা বাল্যবিবাহকে সমর্থন করেন।

২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ। আবার ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয় এ রকম শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ।

বক্তারা বলেন, দেশে বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অষ্টম স্থানে আছে। এর পেছনে সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাবকে দায়ী করেন তাঁরা। এ ছাড়া দেশে ৭৯ শতাংশ শিশু মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বরিশাল বিভাগে এ চিত্র আরও বেশি। বরিশালে বাল্যবিবাহের হার ১৮ বছরের নিচে ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ১৫ বছরের নিচে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি।

সভায় বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘বরিশাল বিভাগে বাল্যবিবাহ, শিশুর প্রতি সহিংসতার হার কেন বেশি—এই প্রশ্ন আমাদের করতে হবে। একই সঙ্গে এর উত্তর খুঁজতে হবে। তবেই এর উত্তরণের পথ বের করা সম্ভব। বরিশাল অঞ্চলের জীবিকা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ভঙ্গুর নয়। তবু কেন এখানে সহিংসতা বেশি? এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব। প্রতিবছর বারবার এ অঞ্চলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে, নদীভাঙনে স্থানান্তর বাড়ছে, নিত্য দুর্যোগে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আর এতে মানুষের মনে শঙ্কা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, এর ফলে বাল্যবিবাহ বাড়ছে, নারীশিশুর প্রতি সহিংসতা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সচেতন গোষ্ঠীকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি সবাইকে ভূমিকা নিতে হবে।’

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে যুগ্ম সচিব এস এম লতিফ বলেন, শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। খেলার মাঠ নেই, সঙ্গী নেই। বাবা-মা সন্তানদের সময় দিচ্ছেন না বা পারছেন না। ফলে শিশুরা মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে শিশুর জীবনবোধ, মূল্যবোধের বিকাশ থমকে যাচ্ছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এটাও একধরনের শিশুর প্রতি সহিংসতা। বকাবকি, শাসন, মারধর এ সবকিছুই শিশুর বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অভিভাবকদের বের হয়ে আসতে হবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মেহেরুন্নাহার বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় এপিসি প্রকল্পের অধীনে কার্যক্রম চলছে। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ম এলাকায় নারীশিশুর প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচারণা শুরু হলো। আশা করি এই কার্যক্রম এই সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।’