ঠাকুরগাঁও-৩ উপনির্বাচন

যে তিন কারণে জোটের প্রার্থী হারলেন, জামানতও হারালেন

ওয়ার্কাস পার্টির প্রার্থী ইয়াসীন আলী (বাঁয়ে) ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাফিজউদ্দীন
ছবি: সংগৃহীত

ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ-রানীশংকৈল আংশিক) আসনের উপনির্বাচনে ১৪–দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ইয়াসিন আলী জামানত হারিয়েছেন। তাঁর এমন পরাজয়ের পেছনে জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের ওপর অনেক বেশি ভরসা, নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অসহযোগিতা ও আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে ফাটল—এই তিন বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করছেন ভোটার ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।

বিএনপির সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমানের পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া এই আসনে গতকাল বুধবার ভোট হয়। নির্বাচনে ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ইয়াসিন আলী (হাতুড়ি), জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাফিজউদ্দীন আহম্মেদ (লাঙ্গল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শাফি আল আসাদ (আম), বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির সিরাজুল ইসলাম (টেলিভিশন), জাকের পার্টির এমদাদুল হক (গোলাপ ফুল) ও স্বতন্ত্র হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র রায় (একতারা) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাফিজউদ্দীন আহম্মেদ ৮৪ হাজার ৪৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী গোপাল চন্দ্র রায় পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩০৯টি ভোট। ইয়াসিন আলীসহ বাকি চার প্রার্থী জামানত হারান। ইয়াসিন আলী পেয়েছেন ১১ হাজার ৩৫৬ ভোট।

জোট প্রার্থীর পাশে ছিল না স্থানীয় আওয়ামী লীগ

ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলায় আওয়ামী লীগের ভিত্তি বেশ মজবুত। ১৯৯১ সালে মোকলেসুর রহমান ও ১৯৯৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহসভাপতি মো. ইমদাদুল হক দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদের দখলে চলে যায় আসনটি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে ইমদাদুল হক দল থেকে মনোনয়ন পেলেও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার কারণে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। ২০০৮ সালে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির একজন করে প্রার্থী থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ইয়াসিন আলী।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আসনটি আবারও ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন ইয়াসিন আলী। কিন্তু কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ দেখা দেয়। নির্বাচনে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করেন ইমদাদুল হক। আর এই বিভাজনের কারণে তাঁদের দুজনই বিএনপির প্রার্থী জাহিদুর রহমানের কাছে পরাজিত হন।

এদিকে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেন। নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে এই আসনে মনোনয়ন পেতে সাবেক সংসদ সদস্য ও পীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদুল হক, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান, রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সইদুল হকসহ কয়েকজন নেতা আবেদন করেন।

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের পীরগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র।

বিএনপির সংসদ সদস্যরা ছেড়ে দেওয়ায় শূন্য হওয়া আসনগুলোর উপনির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গত ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঠাকুরগাঁও-৩ আসন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এবারের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থী আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু না পেয়ে তাঁরা হতাশ হন। সরাসরি বিরোধিতা না করে তাঁরা নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। সে সময় রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সইদুল হক বলেছিলেন, ‘আসনটি বারবার শরিকদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জন্য দুর্ভাগ্য। ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী এবার হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। যাঁরা নৌকায় ভোট দেন, তাঁরা এই প্রতীকে ভোট দেবেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’ নির্বাচন শেষে দেখা গেল, তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।

তবে এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ইয়াসিন আলী আওয়ামী লীগের ওপর ভর করেই নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ১৭ জানুয়ারি জোটের প্রার্থী হিসেবে তাঁর জয় নিশ্চিতে সহযোগিতার জন্য ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মু. সাদেক কুরাইশীকে চিঠি দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সেটা যে কাজে লাগেনি আর ইয়াসিনের পরিকল্পনাও যে যথাযথ ছিল না, ফলাফলের পর তা স্পষ্ট হলো।

সহযোগিতা ছিল না আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের

ওবায়দুল কাদেরের চিঠির পর সভা করে দলের নেতা-কর্মীদের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। নির্দেশনা পেয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা কয়েকটি নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দেন। তবে বেশির ভাগই ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকেন।

ওয়ার্কার্স পার্টির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেন, আওয়ামী বলয়ের লোকজন ভোটের মাঠে গোপাল চন্দ্র রায়কে মাঠে থাকতে সহযোগিতা করেছেন। পাশাপাশি প্রচারণাও চালিয়েছেন।

জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা করে নির্বাচন পরিচালনা করা আমাদের দলের প্রার্থীর প্রধান ভুল ছিল। এলাকায় একটি বিষয় সবার মুখে মুখে ছিল, এবার আওয়ামী লীগ ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীকে জিততে দেবে না। আর এই ষড়যন্ত্রের ফসল এই ফলাফল। নেতা-কর্মীরা যদি জোটের পক্ষে মন থেকে কাজ করতেন, তাহলে আমাদের প্রার্থীই জিততেন।’

আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে ফাটল

আওয়ামী লীগ আসনটি বরাবর ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দিলেও এই আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির ভোট খুবই সামান্য। আওয়ামী লীগের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর জয়লাভ করা সহজ নয়। দীর্ঘদিন দলের কোনো প্রার্থী না পেয়ে ক্ষোভ থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। এই আসনে ভোটারদের একটা বড় একটা অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাঁদের অনেকেই নৌকায় ভোট দেন। পৌর শহরের ফুটপাতে দোকানের মালামাল সরানোকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জানুয়ারি রানীশংকৈল পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং পৌর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবু তালেবের সঙ্গে সেখানকার কয়েকজন হিন্দু ব্যবসায়ীর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় আবু তালেবের নেতৃত্বে শহরে ওই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মিছিল হয়। এতে নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্ষুব্ধ হন। পরে আওয়ামী লীগ আবু তালেবকে দল থেকে বহিষ্কার করে, কিন্তু ক্ষোভ চলে যায়নি।

এবারের উপনির্বাচনে প্রার্থী হন বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ পীরগঞ্জ শাখার সভাপতি গোপাল চন্দ্র রায়। দলের প্রার্থী না থাকায় ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রার্থী পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই গোপালকে ভোট দেন। এতে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে ফাটল ধরে। চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ এই ফাটল আর জোড়া দিতে পারেনি। নির্বাচনে গোপাল চন্দ্র রায় পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩০৯ ভোট, যা ইয়াসিন আলীর প্রাপ্ত ভোটের প্রায় পাঁচ গুণ।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মু. সাদেক কুরাইশী বলেন, ‘এই ফলাফলের কারণ চিহ্নিত করা কঠিন নয়। আমাদের দলের লোকজনই ইয়াসিন আলীকে মেনে নেননি। ফলে প্রার্থীও তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারেননি। আর আমরাও চেষ্টা করে তা করতে পারিনি। পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের যাঁরা সব সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেন, তাঁরা একতারার (গোপাল চন্দ্র রায়) পক্ষে চলে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। তাই বলে জোটের প্রার্থী জামানত হারাবেন, এটা ভাবতে পারছি না।’

১৪–দলীয় জোটের প্রার্থী ইয়াসিন আলী এমন ফলাফল কিছুতেই মেনে নিতে পরছেন না। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভোটাররা এক হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোপাল চন্দ্র রায়কে ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির চাওয়া-পাওয়ার একটা বিষয় কাজ করেছে। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, আমি জয়ী হলে ভবিষ্যতে তাঁদের মনোনয়ন পাওয়ার পদ বন্ধ হয়ে যাবে। সেই কারণে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নির্বাচনী সমাবেশে বক্তব্য দিলেও মাঠে কর্মীদের ঠেকিয়ে রাখেন। আমি আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করেছিলাম, ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে।’