চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে কালুরঘাট সিঅ্যান্ডবি এলাকার দূরত্ব প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার। ভোটের দিন আজ রোববার সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত এই এলাকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। এতে ওই এলাকার আশপাশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ব্যাহত হয়।
সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপির নেতারা। তবে ওই এলাকা থেকে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এক কর্মকর্তা। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁদের শতাধিক রাউন্ড গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে হয়েছে।
ঘটনাস্থলে পুলিশ ছাড়াও র্যাব, বিজিবির একাধিক দল উপস্থিত ছিল। সাঁজোয়া যান আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি), জলকামান নিয়ে ঘটনাস্থলে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। সাঁজোয়া যান নিয়ে উপস্থিত ছিলেন বিজিবির সদস্যরাও।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাতে ওই এলাকার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে নারীসহ শ দেড়েক মানুষ চান্দগাঁও মৌলভি পুকুরপাড় এলাকায় আরাকান সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ভোট বর্জনের দাবিতে তাঁরা নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন সড়ক অবরোধকারীরা। পুলিশও ফাঁকা গুলি ছুড়ে তাঁদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
সড়ক থেকে সরিয়ে দিলেও বিভিন্ন অলিগলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন ভোট বর্জনের দাবিতে বিক্ষুব্ধরা। এতে আশপাশের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র অনেকটা ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও অলিগলি থেকে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ আসতে শোনা যায়।
প্রথম আলোর এই দুই প্রতিবেদক দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রের সামনে অবস্থান করে আশপাশ থেকে অন্তত ৩০টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। স্থানীয় বাসিন্দারা এসব শব্দ ককটেল বিস্ফোরণের কারণে হয়েছে বলে দাবি করলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাতে পটকা ফাটানো হচ্ছে।
বিস্ফোরণের শব্দের মধ্যেই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আবারও মৌলভি পুকুরপাড় এলাকায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। আবারও কয়েক দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে উভয় পক্ষের মধ্যে। পরে একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য এসে অলিগলিতে ঢুকে হামলাকারীদের ধাওয়া দেন। সড়কের পাশের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের সামনে সাঁজোয়া যান নিয়ে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বেলা তিনটার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে তখনো সড়কের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য অবস্থান নেওয়ায় অনেকটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
ঘটনাস্থলে নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাকারীরা বিএনপির নেতা-কর্মী। ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মোহাম্মদ ইদ্রিস বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির ভোট বর্জন কর্মসূচির ডাকে সাড়া দিয়ে চান্দগাঁও এলাকার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা করে। এতে যুবদলের এক নেতাসহ অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
চান্দগাঁও থানায় নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক) মো. আকরামুল হাসান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শতাধিক রাউন্ড গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়েছে। পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছেন।
পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালে সড়কের পাশের অন্তত ১৫টি দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ সময় সড়কের অন্তত ৭ থেকে ৮টি স্থানে সড়কের ওপর টায়ারে আগুন দেন তাঁরা। হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয় আল হেকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ভোটকেন্দ্রের ভেতরে।
র্যাব-৭–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, চান্দগাঁও এলাকায় যেটি হয়েছে সেটি মূলত চোরাগোপ্তা হামলা। গলি থেকে বের হয়ে হামলাকারীরা আবার গলিতে লুকিয়ে গেছেন। বিএনপি ও সমমনা সংগঠন যারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা করেছে, তারাই এই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের ছোড়া ঢিলের আঘাতে র্যাবের একটি যানবাহনের চালক আহত হয়েছেন।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চান্দগাঁও এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিন থেকে চার কিলোমিটার সড়কে ভাঙা ইটের টুকরা পড়ে আছে। পোড়ানো টায়ারের ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি কোথাও টায়ার জ্বলতেও দেখা যায়।
সংঘর্ষের কারণে আরাকান সড়কের আশপাশের একাধিক ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ব্যাহত হয়। বেলা সোয়া দুইটার দিকে আল হেকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে কোনো ভোটার নেই। কেন্দ্রটির সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বিধান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রের আশপাশে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। তাই এক ঘণ্টার মতো ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনায় ভোট পুনরায় শুরু হয়েছে।
আল হেকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত প্রায় চার শতাধিক ভোট পড়েছে বলে জানান বিধান চৌধুরী। কেন্দ্রটিতে ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৯৫৯।
আরাকান সড়কের পাশেই হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রটিতে ভোটার ২ হাজার ৮১ জন। বিকেল চারটা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৪৪৩টি। শতকরা হিসাবে ভোট পড়ার হার ২১ শতাংশ। কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আবুল মনছুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাতেই ভোটকেন্দ্রের পাশে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল থেকেও কেন্দ্রের আশপাশে সংঘর্ষসহ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। এ কারণে ভোট কম পড়েছে।
টেকবাজারপুল হাজী কালামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ জন। ওই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন ৫২৪ জন। ভোটের হার ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
একই এলাকার মনজু পারভিন নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ৩ হাজার ১৩০ জন। কেন্দ্রটিতে ভোট পড়েছে ৪৩২ জনের। ভোটের হার মাত্র ৭ শতাংশ। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল আলম বলেন, কেন্দ্রের পাশে রাতে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। দিনভর কেন্দ্রের অদূরে সড়কে উত্তেজনা ছিল, যার কারণে ভোট কম পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এলাকার শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৭১৭ জন। ভোট পড়েছে ৬৫৯টি। ভোটের হার ১৭ শতাংশ। এলাকায় দিনভর গোলাগুলিসহ নানা সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে ভোট কম পড়েছে ধারণা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অসীম বড়ুয়ার।
অন্যান্য কেন্দ্রে ভোটের হার তুলনামূলক কম থাকলেও সংঘর্ষস্থলের ১০ গজের মধ্যে অবস্থিত হামিদিয়া সরকারি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আসিফ আহসান বলেন, কেন্দ্রের পাশে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও বিকল্প সড়ক থাকায় ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। ৪০ শতাংশ ভোট পড়লেও সংঘর্ষ না হলে তা ৫০ শতাংশ ছাড়াত।
সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে একটি কেন্দ্র প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ রাখার কথা কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা স্বীকার করলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা তনুশ্রী গোস্বামী দাবি করেন, এলাকার কোনো ভোটকেন্দ্রই সাময়িক বন্ধ হয়নি।
চান্দগাঁও এলাকাটি পড়েছে চট্টগ্রাম-৮ আসনে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা (শ্রীপুর-খরনদ্বীপ ইউনিয়ন ব্যতীত) এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ড নিয়ে এই আসন গঠিত। আসনটিতে এবার নির্বাচনে প্রার্থী হন ১০ জন। নৌকার কোনো প্রার্থী এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তবে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম ও সদস্য বিজয় কুমার চৌধুরী প্রার্থী হন। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সোলাইমান আলম শেঠ। আসনটিতে ভোটার ৫ লাখ ১৫ হাজার ৬৪১ জন।