মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির আরও ১৩ জন সদস্য পালিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছেন। আজ শুক্রবার ভোরে তাঁরা বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে ঠাঁই নেন। পরে তাঁদের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম।
সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা ও আজ শুক্রবার ভোর পাঁচটার দিকে রাখাইন রাজ্যের নাকফুরা ও কাওয়ারবিল থেকে পৃথক নৌকা নিয়ে বিজিপির ১৩ সদস্য নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ জলসীমানায় এসে বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর বিজিপি সদস্যদের নিরস্ত্র করে টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশনে আনা হয়। পরে ১৩ সদস্যকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির হেফাজতে আছেন মিয়ানমারের সেনা ও বিজিপির ২৭৪ জন সদস্য।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। রাখাইনের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে আজ শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের উত্তরে বলিবাজার, নাকফুরা, কাওয়ারবিল এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। টানা দুই মাস ধরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে লড়াই ও সংঘাত চলছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে গত বুধবার সকাল পর্যন্ত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৪৬ জন। মঙ্গলবার দিনে প্রবেশ করেন আরও ১৮ জন। আগের দিন সোমবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশফাড়ি সীমান্ত দিয়ে আসেন দেশটির দুই সেনাসদস্য। রোববার টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসেন বিজিপির অপর ১৪ জন সদস্য। গত ৩০ মার্চ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩ জন সদস্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। ১১ মার্চ আশ্রয় নেন আরও ১৭৭ জন বিজিপি ও সেনাসদস্য।
বিজিবি ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৩৩০ জন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ জনের সবাইকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির হেফাজতে থাকা ২৭৪ জনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চলছে। ব্যাটালিয়নের পাশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে পালিয়ে আসা সেনা ও বিজিপি সদস্যদের।
থেমে নেই মর্টার শেলের বিস্ফোরণ
রাখাইন রাজ্যে মংডু টাউনশিপের উত্তরের কয়েকটি গ্রামে থেমে নেই মর্টার শেল ও গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণ। পাঁচ-ছয় দিন ধরে সেখানকার নাকফুরা ও কাওয়ারবিলে বিজিপির সীমান্তচৌকি ও সেনা ব্যারাক দখল নিয়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে আরকান আর্মি। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ শুরু হয়। থেমে থেমে তা আজ শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত চলছিল। ওপারের মর্টার শেল ও গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণ টেকনাফ সীমান্তের মানুষ শুনতে পান। শক্তিশালী গ্রেনেড বোমা ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণে টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও টেকনাফ পৌরসভার নাফ নদীর তীরের অন্তত ১১টি গ্রামে ভূকম্পন অনুভূত হয়।
সীমান্তের একটি সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে আরাকান আর্মি নাকফুরা এলাকার দুটি সীমান্তচৌকি দখল করে নেয়। এরপর চৌকির সদস্যদের (বিজিপি) কিছু মংডুর পূর্ব দিকের কালাদান পাহাড়ে এবং কিছু সদস্য পশ্চিম দিকের নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশ জলসীমানায় অবস্থান করতে থাকেন। এর মধ্যে ১৩ জন বিজিপি সদস্য টেকনাফের কোস্টগার্ড বাহিনীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা দুই মাসের চলমান সংঘাতে আরাকান আর্মির সঙ্গে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে সেনা ও বিজিপি সদস্যরা ব্যারাক এবং সীমান্তচৌকি ফেলে আত্মগোপন করতে শুরু করেন। অন্যান্য এলাকার আরও সরকারি বাহিনীর চৌকি ও ব্যারাক ফেলে পালানোর চেষ্টা করছেন সদস্যরা। সংঘাতে ইতিমধ্যে মংডু টাউনশিপের উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব পাশের রাচিডং টাউনশিপসহ ১২টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। কিছুদিন ধরে বুচিডং ও মংডু টাউনশিপ দখলের জন্য শক্তি প্রয়োগ করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। দখলে নেওয়া সীমান্তচৌকি ও পুলিশ ফাঁড়ি পুনরুদ্ধারে সরকারি বাহিনী বিমান হামলা এবং শক্তিশালী মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমা নিক্ষেপ করলেও তা কাজে আসছে না।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ওপারের বিস্ফোরণের কারণে টানা দুই মাস ধরে টেকনাফ উপজেলার সাত হাজার জেলে নাফ নদীতে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না। নাফ নদীর তীরের জমিতে ধান, শাকসবজির চাষ, মৎস্য ও কাঁকড়া আহরণ করতে পারছেন না আরও সাত হাজার কৃষক-শ্রমিক।