তাঁরা ছয় ভাই। প্রতিবছর দুটি হতদরিদ্র পরিবারকে পাকা ঘর করে দিচ্ছেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় এখনো চলছে দুটি ঘর তোলার কাজ।
মাথা গোঁজার মতো একটি মাটির ঘর। খুপরির মতো সেই ঘরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়ে চায়না খাতুনকে (৩৫) নিয়ে বাস করে আসছিলেন সাহিদা বেগম (৬০)। স্বামী সামছুদ্দিন আহম্মেদকে হারিয়েছেন আজ ২৫ বছর হয়। বিয়ে করে বড় মেয়ে চলে গিয়েছিলেন নিজের সংসারে। সাহিদা বেগম বললেন, তাঁর সংসার চলছিল কোনোমতে, অন্যের বাড়িতে কাজ করে। ঘর পাকা করার স্বপ্ন দেখাও তখন চরম বিলাসিতা। সেই অসম্ভব কল্পনাই হয়ে গেল সত্যি। তিনি এখন বাস করেন পাকা একটি ঘরে।
সাহিদা বেগমের অসম্ভব স্বপ্নকে যেন জাদুর চেরাগের স্পর্শে বাস্তব করে দিয়েছিলেন ঝিনাইদহের সমাদৃত ছয় ভাই। এই ছয় ভাইয়ের আবাস সেখানকার কালীগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে। মনোহরপুরের রফিউদ্দিন বিশ্বাসের সন্তান তাঁরা।
ছয় ভাই স্বপ্ন দেখেন, একে একে গ্রামের সব মাটির ঘর একদিন পাকা হয়ে যাবে। গ্রামে তখন তাঁরা অন্য উন্নয়নের কাজে হাত লাগাবেন।
মনোহরপুর গ্রামে গত পাঁচ বছরে সাহিদা বেগমের মতো আরও ১০টি অতিদরিদ্র পরিবারকেও তাঁরা পাকা ঘর করে দিয়েছেন। প্রতিবছর তাঁরা দরিদ্র দুটি পরিবারের জন্য পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। ঘরগুলোর পাকা মেঝে। দৈর্ঘ্যে–প্রস্থে আকার ১৪ ফুট ও ৯ ফুট। মাথার ওপরে টিনের ছাদ। ঘরের সামনে ছয় ফুট বারান্দা। ঘরের সঙ্গে শৌচাগারের জন্য স্ল্যাবও উপহার দিচ্ছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে একটি করে পাকা শৌচাগারের ব্যবস্থাও করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
মালিয়াট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম খাঁ প্রথম আলোকে বলেন, কী সুন্দর একটা কাজ! অন্য বিত্তবানেরাও যদি এভাবে এগিয়ে আসতেন, এলাকার চেহারাই তাহলে বদলে যেত। একই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইসারত আলী বলেন, ছয় ভাইয়ের কাজ এভাবে চলতে থাকলে গ্রামের সবারই একসময় পাকা ঘর হয়ে যাবে।
মনোহরপুর গ্রামে সম্প্রতি গিয়ে এ রকম ছয়টি পাকা ঘর দেখে এসেছেন এই প্রতিবেদক। প্রতিবেদক গিয়েছিলেন মৃত খলিলুর রহমানের বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী বৃদ্ধা মাহিরন নেছা কাজ করছিলেন পাকা ঘরের বারান্দায় বসে। পাশেই একটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ মাটির ঘর। মাহিরন নেছা বললেন, বিশ্বাস পরিবারের ছয় ভাই পাকা ঘরটি করে দেওয়ার আগে ওই ঘরেই তিনি কোনোমতে থাকতেন।
প্রথম দিকে সরাসরি অর্থ দিতে শুরু করেছিলেন। গরু আর ছাগল কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন দুজন দরিদ্র গ্রামবাসীকে। সে টাকা তাঁরা খরচ করে ফেলেছিলেন। আরও কয়েকজনকে নগদ টাকা দিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
সহিদুল ইসলামের ঘরে গিয়ে পাওয়া গেল স্ত্রী রহিমা খাতুনকে। তিনি ছিলেন ঘরে বসে। রহিমা খাতুন বললেন, আগে থাকার মতো ঘর ছিল না তাঁদের। এখন পাকা ঘরে শান্তি করে ঘুমাতে পারছেন।
ছয় ভাইয়ের বড়জন মিজানুর রহমান বিশ্বাস শিক্ষকতা করতেন বেসরকারি কলেজে। গত ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন। দ্বিতীয় ভাই আজাদুর রহমান বিশ্বাস একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট। সাহানুর রহমান বিশ্বাস তৃতীয় ভাই। গ্রামে নিজেদের জমিজমা তদারক করেন। চতুর্থ ভাই হাসানুর রহমান বিশ্বাস বেসরকারি একটি কোম্পানির সহকারী মহাব্যবস্থাপক। পঞ্চম ভাই সাইদুর রহমান বিশ্বাস থাকেন ঢাকায়। তাঁর চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবসা। সবার ছোট মাহবুবুর রহমান বিশ্বাস একটি মুঠোফোন কোম্পানির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক।
আলহাজ আবু বকর বিশ্বাস মকছেদ আলী কলেজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও ষাটবাড়িয়া মনোহরপুরের বাসিন্দা মুসা করিম বলেন, স্থানীয় লোকজনের কাছে এই ছয় ভাইয়ের পরিচিতি সভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবেই। তাঁদের সবাই ভালো মানুষ বলে জানেন। গ্রামের মানুষের জন্য তাঁরা নীরবে কাজ করে চলেছেন।
দ্বিতীয় ভাই আজাদুর রহমান বিশ্বাস জানান, গ্রামে পাঁচ শতাধিক পরিবারের বাস। অধিকাংশের জীবিকাই কৃষি। শতাধিক পরিবার এখনো মাথা গুঁজে থাকে মাটির ঘরে। তাঁদের ছয় ভাইয়ের মধ্যে দুজন ব্যবসায়ী, তিনজন চাকরিজীবী। আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়। নিজের গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য তাঁদের কিছু একটা করতে মন চেয়েছিল। প্রথম দিকে সরাসরি অর্থ দিতে শুরু করেছিলেন। গরু আর ছাগল কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন দুজন দরিদ্র গ্রামবাসীকে। সে টাকা তাঁরা খরচ করে ফেলেছিলেন। আরও কয়েকজনকে নগদ টাকা দিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, দরিদ্রদের তাঁরা পাকা ঘর করে দেবেন। সে লক্ষ্যে প্রতিবছর তাঁরা তিন লাখ টাকা করে ব্যয় করছেন।
২০১৮ সালে প্রথম তাঁরা সাহিদা বেগম আর সহিদুল ইসলামকে দুটি ঘর তুলে দিয়েছিলেন। সাহানুর রহমান বিশ্বাস জানান, সে বছর প্রতিটি ঘরের জন্য এক লাখ করে দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিবছর দুটি করে পাকা ঘর তাঁরা গ্রামবাসীদের দিয়ে চলেছেন। গত পাঁচ বছরে ঘর পেয়েছেন তাঁদের গ্রামের সাহিদা বেগম, সহিদুল ইসলাম, নছিরন নেছা, খলিলুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, আবদুর রাজ্জাক, ইকবাল হোসেন, কদভানু বিবি, আনিচুর রহমান ও ইসমাইল হোসেন। এঁদের মধ্যে ইকবাল হোসেন প্রতিবন্ধী।
এ বছরও নুর আলী নামে এক গ্রামবাসীর ঘর বানানোর কাজ শুরু হয়েছে। আরও একটি ঘর তাঁরা বানাবেন।
আজাদুর রহমান বিশ্বাস বললেন, তাঁদের ভাইদের মধ্যে খুব মিল। সবার মধ্যেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা। যে যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দেন। বাড়তি কোনো চাপ নেই। প্রত্যেকেই মানুষের জন্য কিছু করতে চান বলেই তাঁরা কাজটি করে যেতে পারছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বললেন, সরকার তো গৃহহীনদের ঘর করে দিচ্ছেই। পাশাপাশি সচ্ছল মানুষও যদি এভাবে এগিয়ে আসতেন, কতই না এগিয়ে যেত দেশ।
ছয় ভাই স্বপ্ন দেখেন, একে একে গ্রামের সব মাটির ঘর একদিন পাকা হয়ে যাবে। গ্রামে তখন তাঁরা অন্য উন্নয়নের কাজে হাত লাগাবেন।