কখনো সাতসকালে অন্যের ভ্যান নিয়ে সবুজ মোড়লকে রাস্তায় নামতে হয় যাত্রীর খোঁজে। আবার কোনো দিন ভ্যান রেখে দিনমজুরির কাজে যান। তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। খাবারের সংস্থান করতেই পকেট খালি হয়ে যায় সবুজের। তাই থাকার ঘর নিয়ে চিন্তার সুযোগ মেলে না। সবুজ মোড়ল ও মনিরা বেগম দম্পতি চার সন্তান নিয়ে থাকতেন একচালা নড়বড়ে ঘরে। এবার সবুজ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ঠাঁই মিলেছে দুই কক্ষের টিনের ঘরে।
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার পানিগাতী গ্রামে পৈতৃক ভিটায় বন্ধুসভার বন্ধুরা ইটের ভিত্তির ওপর দুই কক্ষের টিনের ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। গত শনিবার বিকেলে সবুজের সেই ঘর তুলে দিয়েছেন খুলনা বন্ধুসভার বন্ধুরা।
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বন্ধুসভার একটি ভালো কাজের অংশ হিসেবে সবুজের জন্য ঘরটি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধুসভার সদস্য ও শুভার্থীদের আর্থিক সহায়তায় ও শ্রমে–ঘামে ঘরটি নির্মিত হয়েছে। নতুন ঘর পেয়ে প্রতিক্রিয়ায় সবুজ মোড়ল বলেন, ‘চার বাচ্চাসহ ছয়জনের সংসার। ভ্যান চালায়ে, লেবারগিরি কইরে সংসার চালাতি হিমশিম খাই। তা দিয়ি ঘর বানবো ক্যামনে? বাপের ভিটি যেট্টুক আছে, তাতে এককান ঘর বান্দা যায়, তা টাহা তো থাহা লাগবে?’
আর্থিক সংকটের কারণে ঘর তৈরির সক্ষমতা ছিল না সবুজের। একচালা একটি রান্নাঘরে প্রতিবন্ধী এক সন্তানসহ চার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন সবুজ। তাঁরা যে রান্নাঘরে থাকতেন, সেটির এক পাশ ধসে পড়ে বেশ আগেই। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে কোনো রকম বৃষ্টির পানি আটকানোর ব্যবস্থা ছিল। হালকা ঝড়-বাদলেই নড়বড় করত ঘরটি। উপায় না থাকায় ওই ঘরেই দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছে তাঁদের। এবার নতুন ঘর পেয়ে বেশ খুশি সবুজ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
নতুন ঘর পেয়ে সবুজের স্ত্রী মনিরা বেগমের চোখে চলে আসে আনন্দাশ্রু। আবেগপ্রবণ হয়ে মনিরা বলেন, ‘বিয়ের পর থ্যাকি মাটির এই ঘরে আছি। ভাঙি পড়িছে, তারপরও টাহা না থাকায় ঠিক করতি পারিনি। এ রহম পাকা বাড়ির কথা কখনো স্বপ্নেও দেখিনি। জীবনেও এইরাম ঘর তৈরি করতি পাত্তাম না।’
চার বাচ্চাসহ ছয়জনের সংসার। ভ্যান চালায়ে, লেবারগিরি কইরে সংসার চালাতি হিমশিম খাই। তা দিয়ি ঘর বানবো ক্যামনে?সবুজ মোড়ল, দিনমজুর, পানিগাতী গ্রাম, দিঘলিয়া
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কী ভালো কাজ করা যায়, তা নিয়ে খুলনা বন্ধুসভায় আলাপ চলছিল। ১০ থেকে ১৫ দিন আগে বন্ধুসভার সাপ্তাহিক সভায় সবুজ মোড়লের অসহায়ত্বের গল্প তুলে ধরেন সহসভাপতি শেখ হাফিজুর রহমান। পরদিনই বন্ধুরা ছুটে যান শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ভৈরব নদের ওপারে সবুজ মোড়লের বাড়িতে। তাঁর দুরবস্থা দেখে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বন্ধুসভার সদস্যরা। পরে শুরু হয় তহবিল সংগ্রহের কাজ।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে খুলনায় কয়েক দিন ধরে চলে দিনভর বৃষ্টি। প্রতিকূল আবহাওয়ায় অর্থ সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ এবং শহর থেকে দূরের পথ কোনো কিছুই খুলনা বন্ধুসভার এই উদ্যোগকে দমাতে পারেনি। বন্ধুরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রী জোগাড়; বন্ধুসভার উপদেষ্টা, কার্যনির্বাহী পর্ষদ, বন্ধু ও সুহৃদদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন ‘ভালোবাসার ঘর’।
খুলনা বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক আসফিক আহমাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রথম আলোর প্রতিটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে খুলনা বন্ধুসভা মানবতার কল্যাণে কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। হয়তো খুব বড় কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি থাকে না। এ বছর সবুজ মোড়লের পরিবারের থাকার জায়গার চিন্তাটা আমরা দূর করতে পেরে আনন্দিত।’
বন্ধুসভার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পানিগাতী গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাইদুর রহমান বলেন, সবুজ মোড়লের একটা ঘর বানানোর সামর্থ্যও ছিল না। বন্ধুসভার উদ্যোগে তাঁর কষ্ট লাঘব হলো। সবাইকে এ রকম ভালো কাজে এগিয়ে আসা উচিত।