সুনামগঞ্জ শহরের জেল রোড এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকান। গতকাল রোববার দুপুরে তোলা
সুনামগঞ্জ শহরের জেল রোড এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকান। গতকাল রোববার দুপুরে তোলা

‘টানাটুনিতে পুঞ্জি শেষ, বড় কষ্টত আছি’

‘সবতা বন্ধের (কারফিউ) লাগি এক সপ্তাহ বাড়িত আছলাম। দোকান কুলতাম পারছি না। কিছু পুঞ্জি (পুঁজি) আছিল, টানাটুনিতে সব খাইয়া শেষ। এখন বাকিতে জিনিস আনি। কিন্তু বাজারও মানুষ নাই। বেচাবিকি কম। বড় কষ্টত আছি।’

এই কষ্টের কথা সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা আবদুল জলিলের (৫৫)। শহরের জেল রোড এলাকায় ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা তিনি। আবদুল জলিলসহ অনেকে সেখানে সবজি বিক্রি করেন। ভোরে পাইকারি বাজার থেকে সবজি নিয়ে এসে এখানে সারা দিন বিক্রি করেন তাঁরা। এই আয়েই চলে তাঁদের সংসার।

শুধু সবজি বিক্রেতা আবদুল জলিল একা নন, তাঁর মতো আরও অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও কারফিউয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। অনেকের আয়রোজগার নেই, কারও কমে গেছে আয়। এ অবস্থায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।

আবদুল জলিলের বাড়ি সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বড়পাড়া এলাকায়। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। একমাত্র ছেলে ইয়ামিনুল হককে (১৪) নিয়ে বাজারে সবজি বিক্রি করেন তিনি। এই আয়েই সংসার চলে।

গতকাল রোববার দুপুরে শহরের জেল রোডে গিয়ে কথা হয় আবদুল জলিলের সঙ্গে। তপ্ত রোদে সড়কের এক পাশে খোলা আকাশের নিয়ে নানা জাতের সবজি নিয়ে বসেছেন তিনি। সঙ্গে ছেলে ইয়ামিনুল হকও আছে। সড়কের পাশে সবজি নিয়ে আরও ১০ থেকে ১৫ জন ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা রয়েছেন। বাজারে ক্রেতা আগের চেয়ে কম বলে জানান তাঁরা।

আলাপকালে আবদুল জলিল সংসারের টানাপোড়েন আর সুখ-দুঃখের গল্প শোনান। তিনি জানান, চার বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে আর বিয়ে করেননি জলিল। বড় মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধ। দ্বিতীয় মেয়ে এবার মাধ্যমিক পাস করেছে, কিন্তু কলেজে ভর্তি হতে পারছে না সংসারের টানাপোড়েনের কারণে। তারও পড়ালেখা বন্ধ। একমাত্র ছেলে ইয়ামিনুল হক নবম শ্রেণিতে পড়ে। তবে স্কুলে যায় না। প্রতিদিন সকাল ছয়টায় বাবার সঙ্গে বের হয়। সারা দিন রোদ-বৃষ্টির মধ্যে বাবার সঙ্গে বাজারে সবজির দোকানে থাকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০ থেকে ১১টা বেজে যায়।

প্রতিদিন সকাল ছয়টার দিকে বাজারে এসে পাইকারি সবজি কেনেন আবদুল জলিল ও তাঁর ছেলে ইয়ামিনুল। এরপর সেই সবজি নিয়ে জেল রোডে এসে দোকান সাজিয়ে বসেন। আট থেকে নয় হাজার টাকার সবজি কিনে নিয়ে আসেন তাঁরা। খরচ শেষে দিনে আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পাইকারি বাজারে নগদে কিনলে এক দর, বাকিতে আরেক দর। পুঁজি না থাকায় বেশি দামে সবজি কিনতে হয় তাঁদের। দিনে ছেলের ২০ থেকে ৩০ টাকা এবং বাবার ৩০ থেকে ৪০ টাকা দুপুরে খাবারসহ হাত খরচ আছে। এরপর যা থাকে চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফেরেন জলিল ও ইয়ামিনুল। জীবন-জীবিকার তাগিদে সকালে আবার ফিরতে হয় বাজারে।

পুঞ্জি নিজের থাকলে কয়টা টেকা বেশি পাইতাম। এখন তো বাকিতে সবজি আনি, টেকা বেশি রাখে। লাভ নাই।
আবদুল জলিল, সবজি বিক্রেতা

আবদুল জলিল জানান, কারফিউ চলাকালে সবকিছু বন্ধ ছিল, ব্যবসা নেই; কিন্তু খেতে তো হবে। হাতে ব্যবসার পুঁজি যা ছিল, তা দিয়েই চলেছেন। সব শেষ। এখন বাকিতে মাল এনে বিক্রির পর রাতে টাকা দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু হাত খরচ বাদে এখন আর তেমন কিছুই থাকে না।

আবদুল জলিল মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন,‘পুঞ্জি নিজের থাকলে কয়টা টেকা বেশি পাইতাম। এখন তো বাকিতে সবজি আনি, টেকা বেশি রাখে। লাভ নাই। বড় কষ্টত আছি। আমরার খোঁজ তো কেউ নেয় না।’

পাশে থাকা আরেক সবজি বিক্রেতা লিল মিয়া বলেন, ‘সবার অবস্থাই খারাপ। বেচাবিক্রি নাই। জিনিসের দামও বেশি। মানুষ কিলা চলত, সবাই এই চিন্তায় আছে।’