ফুচকা বিক্রেতা মো. আবদুর রাজ্জাক ওরফে সজীব
ফুচকা বিক্রেতা মো. আবদুর রাজ্জাক ওরফে সজীব

সুখের দিনে অতীত নিয়ে খেদ সজীবের

‘ফু-উ-চ...কা; অ্যাই ফুচ...কাআ।’ আলো-আঁধারি গলিপথে থেকে থেকে হাঁক ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন। অদ্ভুত সুরের সেই হাঁক ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের ছোট-বড় ভবনগুলোতে। গলির মাথায় বানরগাতি কাশেমাবাদ মসজিদ। মসজিদের কোনায় এসে থেমে যান মানুষটি। কাঁধে ঝোলানো কাঠের ছোট স্ট্যান্ডটি এক হাত দিয়ে পাতেন। এরপর মাথা থেকে ফুচকা ভরা অ্যালুমিনিয়ামের ঢাউস গামলা নামিয়ে রাখেন স্ট্যান্ডের ওপর।

তাঁর নাম মো. আবদুর রাজ্জাক। সেটা অবশ্য কেতাবি নাম; মানুষ তাঁকে চেনে সজীব নামেই। বয়স বললেন ২৪-২৫ বছর হবে। ছোটখাটো গড়নের মানুষটিকে দেখে অবশ্য বয়স আরও কম বলে মনে হয়। বয়সের কথা বলতেই সজীবের মুখে লাজুক হাসি। সন্দেহ কাটাতে বললেন, ‘টাউনে আসছি এই ১৫ বছর। ফুচকা বেচতেছি ১৩ বছর। আমার এক ছেলের বয়স ৪ বছর, অন্যটার এই ৬ মাস।’

অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের মতো সজীবেরও দুই ঠিকানা; অস্থায়ীটি খুলনার বাগমারা এলাকার এক ছোট্ট বাসা। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বারইখালী চরকাঠী গ্রামে।

কথায়–কথায় জানা গেল, এত কম বয়সে কেন কাজ শুরু করতে হয়েছিল! বললেন, ‘স্টোরি কতি গিইলি গোড়ার থেকে কওয়া লাগে। কষ্টের দিন গ্যাছে। আমরা তিন ভাই আর দুই বোন। বোন দুটো আর এক ভাইয়ের অনেক আগেই বিয়ে হইছে। টাউনি আসার বছরখানিক পর আব্বু আমাদের রাইখে চট্টগ্রাম চলে যায়। খোঁজখবর রাখত না। যে সময়ডা পড়ার বয়স ধরেন, সেই সময়ডা দুই ভাই সংসার কাঁধে নিসি। এক বেলা স্কুলে যাইতাম আর এক বেলা ফুচকা বেচতাম। সেভেনের পর আর পড়িনি।’

সজীবের বাবা ফিরে এসেছেন। সংসারও মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছে। পড়ালেখা না করতে পারায় খেদটা তবু রয়ে গেছে। সেই অপূর্ণতা সন্তানের মাধ্যমে পূর্ণতা দিতে চান। প্রত্যয়ী কণ্ঠে সজীব বলেন, ‘ধরতে গেলে এখন সুখের দিন। শুধু কষ্ট, পড়াশুনাটা হয়নি। নিয়ত আছে দুই ছেলেরে যত দূর পড়ানো যায়, যে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার।’

এখন রোজ বিকেল ঠিক পাঁচটার সময় ফুচকা নিয়ে বের হন সজীব। নগরের পশ্চিম বানিয়াখামার, নাজিরঘাট, বানরগাতি, নিরালা আবাসিক—এসব এলাকার পাড়া-মহল্লা, অলিগলি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন ফুচকা। ১০টি ফুচকার দাম রাখেন ৩০ টাকা। কোনো মোড় বা বাজারের কাছে কিছুটা সময় দাঁড়ান। এতে বিক্রির পাশাপাশি হাঁটা থেকে কিছুটা বিশ্রাম মেলে। এরপর আবার হাঁটা। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। কপাল খারাপ হলে রাত বাড়ে আরও কিছুটা।

মঙ্গলবার রাত সোয়া আটটার দিকে কথা হচ্ছিল সজীবের সঙ্গে। তখন পর্যন্ত ৫০০ ফুচকার মধ্যে শ তিনেক বিক্রি করতে পেরেছিলেন। গলির মাথায় দাঁড়ানোর বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ক্রেতার দেখা নেই। এরই মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলে ঘরে ফেরার পথে দুই কিশোর ক্রেতার দেখা মেলে। তাদের থেকে দাম নিয়ে টাকা পকেটে রাখার সময় আবারও সজীবের হাঁকডাক, ‘অ্যাই ফুচ…কা।’ গামছায় হাত মুছতে মুছতে সজীব বললেন, ‘গরমকালে সাত শ-আট শ পিস চলে। শীতকালে ৫০০ চালাতিই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপর ধরেন, খাইয়ে-লাইয়ে দিন চলে যায়। সবকিছু বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা থাকে।’

এক যুগের বেশি সময় ধরে এভাবে ফুচকা বিক্রি করেন, গাড়ি করে এক জায়গায় বসে বিক্রি করতে ইচ্ছা করে না? প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থাকার পর সজীব বলেন, ‘ইচ্ছা তো আছে। কিন্তু চালান তো থাকা লাগবে। টাকা গুছানো দরকার। সেটা হচ্ছে না। কাঁচা টাকা তো ভাই, রাখা যায় না।’ তবে ফুচকার দোকান নয়, আরও বড় দোকানের স্বপ্ন দেখেন সজীব। নিজের গ্রামের বাজারে একটা বড় দোকান থাকবে। সব ধরনের মুদি মাল থাকবে সেখানে। চায়ের ব্যবস্থার পাশাপাশি থাকবে সাত-আটটি ক্যারম বোর্ড।

রাত বাড়ছিল, বাড়ছিল সজীবের অস্থিরতাও। শ দুয়েক ফুচকা বিক্রি করে তবেই ঘরে ফিরতে হবে, সেই চিন্তা তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছিল না!