কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির

চাঞ্চল্যকর ৬ রোহিঙ্গা হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি দেড় বছরেও

কক্সবাজারের উখিয়ার থাইনখালী আশ্রয়শিবিরে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে এই মাদ্রাসা-মসজিদে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে ৬ জন রোহিঙ্গা নিহত হন
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আশ্রয়শিবিরগুলোতে গত সাড়ে ৫ বছরে অন্তত ১৪৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং একসঙ্গে ছয়জন রোহিঙ্গাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা। মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার তদন্ত অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও চলছে। কিন্তু ঘটনার দেড় বছরেও চাঞ্চল্যকর ছয় রোহিঙ্গা হত্যা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, চাঞ্চল্যকর দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মির’ (আরসা) সদস্যরা। মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বলে আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলছে। সর্বশেষ গত শনিবার (১৫ এপ্রিল) বিকেলে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৩) আরসা সদস্যরা গুলি ও ছুরিকাঘাত করে রওশন আলী (৫৫) নামের একজন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রওশন ওই আশ্রয়শিবিরের ই-২ ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে পাঁচটি পৃথক সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় দুজন আরসা সদস্যসহ পাঁচ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। গত পাঁচ মাসে আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। আর সাড়ে পাঁচ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে অন্তত ১৪৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতারা জানান, ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবিরের  ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে’ হামলা চালায় আরসা ও তাদের সহযোগী মাদ্রাসা শিক্ষককের (রোহিঙ্গা) সংগঠন ‘উলামা পরিষদ’ এর অন্তত ৩০০ জন সদস্য। তখন মাদ্রাসার অন্তত ২৫ জন শিক্ষক-ছাত্র মসজিদে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় অস্ত্রধারীরা মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালান। গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছয়জন রোহিঙ্গা নিহত হন। আহত হন আরও ১২ জন।

এ ঘটনায় নিহত রোহিঙ্গা আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে উখিয়া থানায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

মামলার প্রধান আসামি করা হয় উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা মৌলভি আকিজ ওরফে মৌলভি অলিকে। তিনি আরসার ক্যাম্প কমান্ডার। ৫ নম্বরে ছিলেন আরসার আরেক কমান্ডার ওয়াক্কাসের নাম। গত মার্চ মাসে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ওয়াক্কাস।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ছয় রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের পর আরসার সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আরসাকে ঠেকাতে আশ্রয়শিবিরে গড়ে ওঠে আরও অন্তত ১০টি সশস্ত্র বাহিনী। গত দেড় বছরে আরসার সঙ্গে ২৫টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ১৪ রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) যেমন খুন হয়েছেন, তেমনি অন্যদের গুলিতে আরসার ১০ জনের বেশি সদস্যও নিহত হয়েছেন। বর্তমানে এই সংঘাত আরও তীব্র হচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে।  

তদন্ত শেষ পর্যায়ে

পুলিশ জানিয়েছে, ৬ রোহিঙ্গা হত্যা মামলার তদন্ত করছে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। ঘটনার সাত মাসের মাথায় এপিবিএন আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে আরসার চারজনসহ অন্তত ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

১৪ এপিবিএন সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন ওই সময় কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মধ্যে জানে আলম (৩৭) নামের এক রোহিঙ্গা ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দাশের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি একই আদালতে আবদুল মালেক নামে আরেক রোহিঙ্গা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। প্রায় এক বছর ধরে মামলার তদন্ত করছে কক্সবাজার পিবিআই।

তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে। মামলায় আরসার সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি সরওয়ার আলম।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় আরসার অনেকে আসামি হলেও বাহিনীর প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ কয়েকজনের নাম পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে বাদ পড়েছিল। ছয় রোহিঙ্গা হত্যা মামলাতেও আরসার সম্পৃক্ততার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এই মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষ পর্যায়ে বলে জানানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল হলেই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হবে। এই মামলার অন্তত ২৫ জন আসামি কারাগারে আছেন।