বসন্ত–সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে আকাশে উঁকি দিচ্ছিল এক ফালি চাঁদ। ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের পাখি তখন দল বেঁধে ফিরছিল বাড়িটিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির বাঁশঝাড়সহ সব গাছপালা বক, পানকৌড়িসহ দেশি পাখিদের দখলে চলে যায়।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের হাওরপারের গ্রাম বড়কাপনের মাহমুদ মিয়ার বাড়ির গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দৃশ্য এটি। ১৫-১৬ বছর ধরে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাড়িটি পাখিদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। বাড়িটির লোকজনও বন্ধুত্ব করে নিয়েছেন পাখিদের সঙ্গে। মমতা, ভালোবাসা ও নিরাপত্তায় পাখির দলটিকে আগলে রাখছেন তাঁরা।
বাড়ির মালিক মাহমুদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে পাখিরা আসে তা–ও ১৫-১৬ বছরের বেশি সময় হবে। বছরের কয়েক মাস থাকে, তারপর আবার চলে যায়। বক, পানকৌড়ি, হাঁস, শালিকসহ অনেক রকমের পাখি আসে। আমরার খুব ভালো লাগে। কাউকে পাখি মারতে দিই না। মারলে কোন দিন পাখি আসা ছেড়ে দিত। পাখি একটি উপকারী প্রাণী—আমরা অনেকেই এটা বুঝি না।’
বিকেলের শেষভাগে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, তখনো পাখিদের আনাগোনা খুব একটা নেই। বাড়ির বিভিন্ন গাছে বিচ্ছিন্নভাবে দু–চারটা সাদা বক ডানা গুটিয়ে বসে আছে। পাখিদের গায়ের একটা বুনো গন্ধ বাড়ির বাতাসে। বাড়ির লোকজন উৎসাহের সঙ্গে বলছিলেন, পাখিরা সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে। কথাবার্তা বলতে বলতেই পরিবেশ বদলে যেতে থাকে। ফিরতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে বক। পাখিদের আগমনী কিচিরমিচিরে বাড়ির আকাশ মুখর হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে পাখিরা দল বেঁধে বাড়ির সব বাঁশঝাড়ে এসে বসে।
সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে পাখিদের সাদা পালক মিশে থাকে বাঁশপাতার সঙ্গে। আশপাশের আম, কাঁঠাল, সুপারি, গাবসহ অন্য সব গাছও ততক্ষণে পাখিদের দখলে চলে গেছে। শুধু বক নয়, অনেক পানকৌড়িরও বাস বাড়িটিতে। কিন্তু গাছে বসেই শান্ত হয়ে যায়নি এগুলো। চলছে ডাকাডাকিও। হঠাৎ করেই কোনো গাছ থেকে একঝাঁক পাখি উড়াল দিচ্ছে। বাড়ির আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়ে আবার আগের স্থানে এসে বসছে।
বাড়ির তরুণ বাসিন্দা আফসার আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাখি আমাদের কোনো সমস্যা করে না। আমাদের ভালোই লাগে। সন্ধ্যার আগমুহূর্ত থেকে আসা শুরু করে। রাতে একটা আরেকটার সঙ্গে মাইর-দরবার (ঝগড়াঝাটি) ও ডাকাডাকি করে। আবার শান্ত হয়ে যায়। ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে গাছ ছাড়তে থাকে। বর্ষার আগে ঝড়-তুফানের সময় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।’
বাড়িটিতে মাঘ মাসের দিকে পাখিরা আসতে শুরু করে এবং বৈশাখের দিকে চলে যাওয়ার সময় হয় এগুলোর। বাড়ির সদস্যরা জানিয়েছেন, এ বছর বাড়িতে পাখি আসতে শুরু করেছে দেড় মাস হলো। শুরুতে পাখি কম এলেও আস্তে আস্তে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় পুরো বাড়িটাই পাখিময় হয়ে ওঠে। সকাল হলেই বাড়ির গাছপালা ছেড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাওর ও খেতের দিকে চলে যায়।
সারা দিন এগুলোর আর খোঁজ থাকে না। সন্ধ্যা হলেই দল বেঁধে উড়ে আসতে থাকে পাখিরা। ঝড়ের সময় পাখিরা গাছের নিচের অংশে, অনেকটা মাটিতেও নেমে আসে। ঝড় শেষে প্রকৃতি যখন শান্ত হয়ে আসে, পাখিরা আবার গাছে গাছে উঠে যায়। অনেক পাখি আহতও হয়। সকালবেলা এ রকম আহত পাখিদের তাঁরা গাছে তুলে দেন। একসময় আহত পাখি শক্তি সঞ্চয় করে আবার উড়ে দলের সঙ্গে মিশে যায়।
বড়কাপন গ্রামের পরিবেশকর্মী রাজন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, এই বাড়িতে প্রতিবছরই পাখি আসে। কয়েক বছর ধরে পাখির সংখ্যা বেড়েছে। সন্ধ্যা হলেই পাখির ডাক ও ওড়াউড়িতে ভিন্ন এক পরিবেশ তৈরি হয়। বাড়ির লোকজনসহ পাড়াপ্রতিবেশীও পাখিদের প্রতি খুব আন্তরিক। এখানে কেউ পাখি শিকার বা পাখির ক্ষতি করতে পারে না। তাই এই বাড়িতে পাখিরা নির্বিঘ্নে বাস করতে পারে।’