ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিকে হারিয়ে দিশাহারা হালিমা খাতুন

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত লুৎফর রহমান, তাঁর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও ছেলে মাহিন
ছবি: প্রথম আলো

‘সোমবার ভোরে (ফজরের নামাজের আগে) স্বপ্নে দেখি, আমার ছেলে লুৎফর দুর্ঘটনায় পড়ছে। এরপর ঘুম থাইক্যা উইঠা ওর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলি। আমারে বলল, ও (লুৎফর) ভালো আছে। মঙ্গলবার সাহ্‌রি খেয়ে লুৎফর আমারে ফোনে বলল, “আম্মা, বাড়িতে আসতাছি। বাড়িতে আইসা সবার জন্য ঈদের কাপড়চোপড় কিনা দিব।” আমার ছেলে বাড়িতে ঠিকই এল, কিন্তু জীবিত নয়, লাশ হইয়া। সঙ্গে আমার ছেলের বউ আর নাতিও লাশ হইয়া গেল। ওরা তিনজন দুর্ঘটনায় মইরা যাওয়ায় আমার পরিবারে ঈদের আনন্দ মাটি হইয়া গেছে। আমার দেখা দুঃস্বপ্নই সত্যি হইল।’

আজ বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের দিন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সদর ইউনিয়নের দীঘিরপাড় গ্রামের বাড়িতে লুৎফর রহমানের মা হালিমা খাতুন (৬৫) এসব কথা বলেন। এ সময় স্বজনেরা হালিমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। হালিমা দীঘিরপাড় গ্রামের মো. অহির আলীর স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার দুপুরে ঈদের ছুটিতে মাহিন্দ্রায় বাড়ি ফিরছিলেন লুৎফর রহমান, তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান। এই সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ল্যাংড়াবাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা টাঙ্গাইলগামী প্রান্তিক সুপার বাসের পেছনে ধাক্কা খায় মাহিন্দ্রাটি। এতে লুৎফর রহমান (৩০), লুৎফরের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন (২৫) ও তাঁদের ২ বছরের ছেলে মাহিন মারা যায়। আহত হয় লুৎফর রহমানের ৪ বছরের ছেলে মুজাহিদ। লুৎফর গাজীপুরের শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

আজ দুপুরে লুৎফর রহমানদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িটিতে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া বিরাজ করছে। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা নিহতদের কবর জিয়ারত করছেন। লুৎফরের বাবা-মা আহাজারি করছেন।

লুৎফরের বাবা অহির আলী (৮৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই অসুস্থ। বাড়িভিটার ১৭ শতাংশ জমি ছাড়া কোনো আবাদি জমি নেই। আমগরে চিকিৎসা ও ওষুধের সমস্ত খরচ লুৎফরই দিত। এখন লুৎফর মইরা গেছে। আমগরে ওষুধের ও সংসারের খরচ কে দিব? কেমনে কইরা সংসার চালামু। এইডা নিয়াই খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত লুৎফর রহমানের বাবা মো. অহির আলী ও মা হালিমা খাতুনের আহাজারি। গতকাল দুপুরে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার দীঘিরপাড় গ্রামে

লুৎফরের পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীঘিরপাড় গ্রামের অহির আলীর তিন স্ত্রীর মধ্যে দুজন স্ত্রী মারা গেছেন। তৃতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুনের ঘরে লুৎফর রহমানের জন্ম। লুৎফর সবার ছোট। বড় ভাই হাফিজুর রহমান ও বাবুল মিয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম বেতনের চাকরি করেন।পরিবারটি খুবই অসচ্ছল। লুৎফর যে টাকা বেতন পেতেন, তা থেকে পরিবারকে সহযোগিতা করতেন।

লুৎফরের বড় ভাই হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক প্রয়োজনে লুৎফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এই ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়েও পরিবারে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। স্বজনদের দেওয়া টাকা দিয়ে তিনজনের লাশ আনার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া পরিশোধ করেছেন।

লুৎফরের প্রতিবেশী দীঘিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুতে পুরো পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়েছে।তিন দিন ধরে লুৎফরের বাড়িতে রান্না হয় না। ঈদের দিন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা খাবার দিয়ে গেছেন। সেগুলোই লুৎফরের বাবা-মা খেয়েছেন।

ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আবদুর রকিব প্রথম আলোকে বলেন, লুৎফরের পরিবারটি এমনিতেই গরিব। তার ওপর লুৎফরের মৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। পরিবারটিকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

লুৎফর রহমান, তাঁর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও তাঁদের ছেলে মাহিনকে গতকাল বুধবার সকালে দীঘিরপাড় গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।এর আগে মঙ্গলবার রাতে একটি অ্যাম্বুলেন্সে নিহতদের লাশ বাড়িতে এসে পৌঁছালে স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।