মিয়ানমারে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা, অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর–তরুণেরা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের পাহাড়ি ঢালে খুপরিঘরে স্ত্রী, এক বোন ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন রোহিঙ্গা রমজান আলী (৪৭)। শরণার্থী হিসেবে পাচ্ছেন চাল, ডাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। এ ছাড়া দিনমজুরির কাজ করে রমজানের দৈনিক আয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

আশ্রয়শিবিরে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে রমজান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমারের সামরিক সরকার। রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলেও স্বীকার করছে না তারা। আমরা এখন কোথায় যাব?’

রমজান আলীর মতো বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই জানেন না, কবে তাঁরা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে আশ্রয়শিবিরে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

২২ আগস্ট মধুরছড়া বাজারের ভেতর একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন ১৫ থেকে ২০ রোহিঙ্গা। ২৫ আগস্ট ‘গণহত্যা দিবস’ নিয়ে আলোচনা করছিলেন তাঁরা। আড্ডার একজন সলিম উল্লাহ বলেন, এবারের দিবসটি পালনে তরুণদের অংশগ্রহণ থাকবে বেশি। কারণ পাঁচ-ছয় লাখ কিশোর-তরুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ ও উদ্বিগ্ন। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় তাঁদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে মাদক-সন্ত্রাসে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। তারা রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ, পুরুষ সদস্যদের হত্যাসহ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা।

ফেরার অনিশ্চয়তা

মধুরছড়া বাজারের আড্ডায় তরুণ সালামত উল্লাহ গত ১৯ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘বাড়ি চলো’ ক্যাম্পেইনের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, ‘ওই ক্যাম্পেইন থেকে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে পেরেছিলাম, রোহিঙ্গারা যে পথে বাংলাদেশ এসেছে, সেই পথেই মিয়ানমারে ফিরতে চায়। ফিরে যাওয়ার রাস্তা করে দিন।’

কিন্তু এটা অতটা সহজ নয় বলে নিজেই মনে করেন সালামত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মিয়ানমারে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই। সেখানেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-সংঘর্ষ চলছে।

উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া এবং টেকনাফের শালবন, জাদিমুড়া আশ্রয়শিবির ঘুরে শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, ২৫ আগস্টের ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করে বাড়ি ফেরার আকুতি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চায়। যাতে আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ওইদিন আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের ওপর গণহত্যার বিচার দ্রুত কার্যকরের দাবিও জানাবেন রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, আশ্রয়শিবিরের সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। বাকি রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনবিরোধী। তারা মাদক চোরাচালান, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপকর্মে জড়িত।
রোহিঙ্গাশিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক সৈয়দ হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, গণহত্যা দিবসকে ঘিরে আশ্রয়শিবিরে নাশকতা ঠেকাতে সজাগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিবিরে প্রত্যাবাসনবিরোধী বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠন করছে রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফর লিগ্যাল অ্যাকশন, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ইউনিটি টিম, ভয়েস অব রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নসহ অনেক রোহিঙ্গা সংগঠন। এগুলোর নেতৃত্বে বেশির ভাগ তরুণ-যুবক। যদিও আরসা ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে সংগঠনগুলোর নেতারা প্রকশ্যে আসতে চান না।

এ মুহূর্তে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ নেই বলে মনে করেন এমন একটি সংগঠনের সমন্বয়ক সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গারা যাতে রাখাইনে ঢুকতে (অনুপ্রবেশ) না পারে, সে জন্য মিয়ানমার সীমান্তে ইতিমধ্যে ২৫০ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। সীমান্তে পোঁতা হয়েছে স্থলমাইন। রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা পল্লি নিশ্চিহ্ন করে সেখানে গড়া হচ্ছে মগ সম্প্রদায়ের বসতি, তৈরি করা হচ্ছে সেনা ব্যারাকসহ নানা স্থাপনা। প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমার সরকার চাইবে রোহিঙ্গাদের সেখানকার (মংডু) ট্রানজিট ক্যাম্পে ফেলে রাখতে। রোহিঙ্গারাও জন্মভিটা ফেলে ট্রানজিট ক্যাম্পে যেতে রাজি হবে না।

এসব শুনে পাশে থাকা রোহিঙ্গা হামিদুর রহমানের জিজ্ঞাসা, ‘তাহলে আমরা কোথায় যাব, কোন পথে ফিরব নিজ ভূমিতে?’

অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর–তরুণেরা

২২ আগস্ট বিকেলে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের বালুরমাঠ থেকে ১ হাজার ৬০টি ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা তরুণকে গ্রেপ্তার করেন এপিবিএন সদস্যরা। ৮ আগস্ট একই এলাকা থেকে একটি অস্ত্র, একটি গুলি ও এক হাজার ইয়াবাসহ আরেক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় আরও পাঁচজন রোহিঙ্গা কিশোর-তরুণকে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ইয়াবা ও অস্ত্র নিয়ে গ্রেপ্তার রোহিঙ্গার ৮০ শতাংশ কিশোর ও তরুণ। আশ্রয়শিবিরে তাদের কোনো কাজ নেই। ফলে মাদক সেবন, বেচাকেনা ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ১৭ প্রকারের অপরাধের বিপরীতে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৩০৯টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫ হাজার ২২৯ জনকে। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৩ বছর। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৬৪টি মাদক আইনের মামলায় আসামি ২ হাজার ৩৮৫ জন, যার ৭০ শতাংশ তরুণ ও যুবক।

শরণার্থীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেবা দিচ্ছে শতাধিক দেশি–বিদেশি বেসরকারি সংস্থা। পাঁচ বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় আশ্রয়শিবিরে কাজ করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এসব সংস্থার কর্মীরা।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি এনজিও ফোরামের কো-চেয়ারম্যান আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাদক চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম, ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা তরুণ-যুবক বেকার। তারা মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে। অসামাজিক কার্যকলাপ বাড়ছে। তরুণ-যুবকদের ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা নেই।

অনেক তরুণ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে জানিয়ে আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, তরুণদের একটি অংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।

স্থানীয়দের বিষফোড়া

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যখন দলে দলে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে অনুপ্রবেশ করতে থাকে, তখন তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন স্থানীয় অধিবাসীরা। মানবিক সেবা দিতে এগিয়ে এসেছিল সারা দেশের মানুষ।

কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের ‘বিষফোড়া’ মনে করেন স্থানীয় লোকজন। কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ফরিদুল আলম বলেন, মাদক চোরাচালান, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন ও অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে অনেক রোহিঙ্গা। জেলার শ্রমবাজারও এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। তাতে অন্তত ছয় লাখ শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে, যা ভালো চোখে দেখছেন না স্থানীয় অধিবাসীরা।
রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে না পারলে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন নাগরিক সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। পাঁচ বছরে জন্ম নিয়েছে দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশু। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে জন্ম নেবে আরও কয়েক লাখ শিশু। এর ফলে আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।