করতোয়ায় নৌকাডুবি

মাঝনদীতে নৌকাটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়েছিল

৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থের নৌকাটিতে ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। দুর্ঘটনার দিন বিকেলে নৌকাটি স্থানীয়রা নদী থেকে তুলে আনেন
ফাইল ছবি

ঘটনার দিন সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে বৃষ্টি কমে। একসঙ্গে অনেক যাত্রী নদী পার হতে ঘাটে আসেন। মানুষের ভিড়ের তুলনায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের উপস্থিতি ছিল কম। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মৌখিক নিষেধ উপেক্ষা করে হুড়োহুড়ি করে ৩০-৪০ জন ধারণক্ষমতার নৌকায় ১০৫ জন যাত্রী ওঠেন।

ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে নৌকাটি মাঝনদীতে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। মাঝি নতুন করে ইঞ্জিন চালু করতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। ইঞ্জিন চালুর পরপরই নৌকাটি দুলতে থাকে। তখন নৌকার দুই পাশে বসা নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে পানিতে হাত নাড়াচ্ছিলেন। এ সময় নৌকাটি কাত হয়ে এক পাশে পানি উঠতে শুরু করে। একপর্যায়ে নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়।

৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ছয়জন, জীবিত উদ্ধার হয় ২৭ জন, ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার হয় এবং এখনো তিনজন নিখোঁজ আছেন।

২৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে ফেরা যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের ত্রিস্রোতা মহাপীঠধাম শ্রীশ্রী বোদেশ্বরী শক্তিপীঠ মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্য প্রতিবছর মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়। আরাধনার মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবীকে। সেখানে এক দিনে অন্তত ১০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন থেকে বড়শশী ইউনিয়নে মন্দিরে যেতে আউলিয়ার ঘাট দিয়ে করতোয়া নদী পার হতে হয়। এবার মহালয়ার দিনে আউলিয়ার ঘাটে সকাল থেকে পারাপার হন কয়েক শ মানুষ। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় দুপুরে একসঙ্গে অনেকে মন্দিরে যেতে ঘাটে আসেন। ভিড়ের মধ্যে সেখানে ছিলেন মাত্র তিনজন পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া ঘাটে দায়িত্বে ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের সাতজন সদস্য। স্বয়ং মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ঘাটে ছিলেন। তাঁরা ওই নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে মৌখিকভাবে নিষেধ করলেও সরাসরি বাধা দেননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ছয়জন, জীবিত উদ্ধার হয় ২৭ জন, ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার হয় এবং এখনো তিনজন নিখোঁজ আছেন। সাধারণভাবে নৌকাটিতে খুব চাপাচাপি করে হলেও ৩০ থেকে ৪০ জন যাত্রী ওঠা যায়। অভিযোগ উঠেছে, ইজারাদার বেশি টাকার আশায় এবং মানুষের তাড়াহুড়োর কারণে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি যাত্রী ওঠান।

পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত নৌকাটি যে আকৃতির, সে অনুযায়ী স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং আমাদের পর্যাালোচনায় তাতে স্বাভাবিকভাবে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো যাত্রী ওঠা যায়। তবে যাত্রীদের ওজন এবং আকার-আকৃতির তারতম্যে তা সামান্য কমবেশি হতে পারে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করা ফায়ার সার্ভিসের একজন সদস্য বলেন, তাঁরা সাতজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে পুলিশ ও তাঁরা নিষেধ করলেও কোনো সুফল পাননি। ভিড়ের মধ্যে অনেকে জোর করে নৌকায় উঠে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

ফায়ার সার্ভিসের ওই সদস্য আরও বলেন, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পরপরই যাত্রীরা নদীতে ভাসতে থাকেন। তাঁরা প্রায় ৪০০ গজ দক্ষিণে দিকে দৌড়ে গিয়ে ভেসে যাওয়া মানুষকে ধরতে থাকেন। এ সময় স্থানীয় কয়েকজন তাঁদের সহায়তা করেন। ঘটনার পর প্রথম দফায় আটজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে একে একে ১৬টি লাশ উদ্ধার করেন তাঁরা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর আউলিয়ার ঘাটটি দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেয় জেলা পরিষদ। এবার সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিয়ে ঘাটটি ইজারা নেন আবদুল জব্বার নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে অংশীদার ছিলেন আরও চার ব্যক্তি। নদীতে পানি কমে গেলে প্রায় পাঁচ মাস বাঁশের সাঁকো দিয়ে মানুষ পারাপার করা হয়। বাকি সাত মাস একটি নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার হয়। আউলিয়ার ঘাট থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উত্তরে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে বড়শশী ইউনিয়নে বয়ে যাওয়া ঘোড়ামারা নদী। দুটি নদীরই উৎপত্তিস্থল ভারতে। উত্তরে বৃষ্টি হলেই দুই নদী মোহনার পর আউলিয়ার ঘাটে করতোয়ায় পানি ও স্রোত বাড়ে।

নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে ফেরা নুর নবী (৩০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা হাচেন আলীসহ (৭০) আমরা ওই নৌকায় ছিলাম। বাবা ঘাট ইজারাদারদের মধ্যে একজন, যিনি নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তবে আমি কোনোমতে বেঁচে ফিরেছি। গ্রাম পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা নিষেধ করার পরও নৌকাটিতে অতিরিক্ত যাত্রী উঠেছিল।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নুর নবী বলেন, নৌকাটির দুই পাশে বসা নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে পানিতে হাত নাড়াচ্ছিলেন। তখন নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। মাঝি পুনরায় ইঞ্জিন চালু করলে নৌকাটি দুলতে থাকে। তখন হাতমাইকে ফায়ার সার্ভিসের একজন মাঝিকে সাবধান করছিলেন। মাঝি নৌকাটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। তখন হঠাৎ করেই নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়।

ইজারাদার আবদুল জব্বারের দাবি, ঘটনার দিন ঘাটে তাঁদের চারটি নৌকা চলছিল। এর মধ্যে দুটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ও দুটি ছোট নৌকা। ঘটনার দিন সকালে বৃষ্টি হওয়ায় দুপুরে মানুষের ভিড় ছিল বেশি। পুলিশসহ তাঁদের লোকজন বাধা দিয়েও যাত্রীদের থামাতে পারেননি। এ ছাড়া টানা দুই দিন বৃষ্টি হওয়ায় নদীতে স্রোতও বেশি ছিল। ওই দিন তাঁদের কোনো অব্যবস্থাপনা ছিল না।

২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই মহালয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি নদীতে ডুবে যায়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠন করা পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির আজ রাত ১২টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা আছে।