চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও আইন বিভাগের চলমান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল চেয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছে শিক্ষক সমিতি। আজ রোববার বেলা দুইটায় এ অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। বিকেল পাঁচটায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কর্মসূচি চলছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে শিক্ষক সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ও শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, কোন বিভাগে কতজন শিক্ষক দরকার হবে, তা নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি। এরপর শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর এসব তথ্য পাঠানো হয় নিয়োগ বোর্ডে। বোর্ড প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং নিয়োগের সুপারিশ করে। পরে সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়।
বাংলা ও আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি বারবার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানালেও উপাচার্য তাঁর বিশেষ ক্ষমতার বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। একই ক্ষমতার ব্যবহার করে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্যও ডাকা হয়েছে।
আজ বেলা দুইটায় আইন বিভাগের দুই প্রভাষক পদের বিপরীতে সাক্ষাৎকার হওয়ার কথা ছিল। এতে ১০ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। আগামীকাল সোমবার বাংলা বিভাগের সাত শিক্ষক পদের বিপরীতে আবেদন করা প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে আবেদন করেছেন ৮২ জন। শিক্ষক সমিতি এ দুটি বিভাগেরই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল চেয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় উপাচার্যকে চিঠি ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সমিতি। সর্বশেষ গত ২৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধ করা, আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দেওয়াসহ ২৬টি দাবিতে উপাচার্য শিরীণ আখতারকে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে শিক্ষক সমিতি। দাবি পূরণ না হলে লাগাতার কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সমিতির নেতারা।
এ ঘোষণার সূত্র ধরে আজ বেলা ১১টায় বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকদের নিয়ে সভা করেন সমিতির নেতারা। সভা শেষে দুপুর সাড়ে ১২টায় উপাচার্য শিরীণ আখতারকে বাংলা ও আইন বিভাগের নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল চেয়ে চিঠি দেয় সমিতি। এ চিঠি নিয়ে শিক্ষক সমিতির নেতারা উপাচার্যের কার্যালয়ে গেলে সেখানে দুই পক্ষের বাগ্বিতণ্ডা হয়।
দুপুর সাড়ে ১২টায় উপাচার্য শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, উপাচার্য শিরীণ আখতার সমিতির সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকীকে চিঠিতে কী লেখা আছে তা পড়তে বলছেন। এ সময় শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের ছয়জনসহ বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের অন্তত ৫০ শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।
উপাচার্যের কথামতো মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী চিঠি পড়া শুরু করেন, তবে দুই পৃষ্ঠার এ চিঠির তিন ভাগের এক ভাগও পরে শেষ করতে পারেননি তিনি। এর আগেই উপাচার্য আসন ছেড়ে অন্য একটি কক্ষে চলে যান। এ চিঠিতে বিভাগের সম্মতি না থাকার পরও অতি উৎসাহী হয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা, নিয়োগ–বাণিজ্যের আর্থিক লেনদেনের অডিও ফাঁসের পরও জড়িত কর্মচারী–কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। উপাচার্য এসব কথা চিঠি থেকে পরিহার করার দাবি জানিয়েছিলেন। তবে শিক্ষক সমিতি তা করতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে উপাচার্য তাঁর কক্ষ ত্যাগ করেন।
উপাচার্য কক্ষ ত্যাগ করার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকা বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক সাংবাদিকদের কার্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তাঁদের দাবি, শিক্ষকদের কথার মধ্যে সাংবাদিক থাকতে পারবেন না। পরে জোরপূর্বক সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার ও সহকারী প্রক্টর নাজেমুল মুরাদ। তবে কিছুক্ষণ পরই শিক্ষক সমিতির সভ্য মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী প্রক্টরকে বাধা দেন। তিনি বলেন, ‘এখানে লুকোচুরির কিছু নেই, যা বলার সবার সামনেই হবে।’ এ নিয়েও প্রশাসনে যুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির বিতণ্ডা হয়।
এ বিতণ্ডার একপর্যায়ে শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের ছয় সদস্যকে সভার জন্য কার্যালয়ের পাশে উপস্থিত সভাকক্ষে ডাকেন উপাচার্য। তবে প্রায় ৩০ মিনিট বসিয়ে রেখেও তিনি সমিতির কারও সঙ্গে সভা করেননি। এরপরই বেলা দুইটার দিকে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন সমিতির সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী।
জানতে চাইলে মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় আধা ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর তিনি (উপাচার্য) বলেছেন, পবিত্র জায়গায় উচ্চবাচ্য হয়েছে, এ কারণে তিনি অপমানিত হয়েছেন। এ জায়গা কতটুকু পবিত্র রেখেছেন, তা বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ দেখলে বোঝা যায়। নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এসব বিষয়ে জানতে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। পরে প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও কথা বলতে চাননি। তবে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা বিভাগের পদগুলো অবসর ও পদত্যাগজনিত কারণে খালি ছিল। নতুন করে সৃষ্টি হওয়া কোনো পদ নয় এসব। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে এসব কারণে খালি হওয়া পদগুলোর বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা ছিল। তবে তিনবার বিভাগকে জানানোর পরও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। তাই উপাচার্যের ক্ষমতার বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে। আর আবেদনের যে যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটিও একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন করা হয়েছে।