স্ত্রী রাশিদা ১০০ টাকা মজুরিতে রোজ কাজ করে যা পান, তা দিয়েই খুব কষ্টে কাটছে তাঁদের জীবন।
ছেলেমেয়ে থাকতে নেই। তাঁরা বিয়ের পর বৃদ্ধ মা-বাবাকে পর করে দিয়েছেন। জীবনের শেষ বেলায় ৭০ বছর বয়সী জয়নাল ব্যাপারীর পাশে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব রাশিদা বেগম। জয়নাল ব্যাপারী চার মাস ধরে ঘরে শয্যাশায়ী। স্ত্রী রাশিদা ১০০ টাকা মজুরিতে রোজ কাজ করে যা পান, তা দিয়েই খুব কষ্টে কাটছে তাঁদের জীবন।
জয়নাল ব্যাপারীর আক্ষেপের শেষ নেই। তিনি মেনে নিয়েছেন, কষ্টই তাঁর জীবনের একমাত্র সঙ্গী। শয্যাশায়ী জয়নাল ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ বছর ধইরা চেয়ারম্যান-মেম্বারগো দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ একটা কার্ডও কইরা দেয় নাই। কেউ ১০ সের চাউল দিয়াও জিগায় নাই; একখান স্লিপও কেউ দেন নাই। বয়স্ক ভাতা তো আর পাইলাম না। আমি মরলে স্ত্রী যদি বিধবা ভাতার কার্ড পায়, সেই ব্যবস্থাটা কাইরা দিয়েন।’
জয়নাল ব্যাপারীর বাড়ি ছিল মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের মোবারকদি এলাকায়। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। নিজের কোনো জমি না থাকায় ছেলেমেয়েদের ঘরে আর ঠাঁই হয়নি জয়নাল ও রাশিদার। প্রায় ছয় মাস আগে ভূমিহীন এই বৃদ্ধ দম্পতিকে আশ্রয় দিয়েছে সরকার। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে রাশিদা বেগমের নামে সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের আদমপুর এলাকায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে নির্মিত দেড় শতাংশ জমির একটি পাকা ঘর দেওয়া হয়েছে। তবে ঘর ছাড়া আর কোনো সহযোগিতা জোটেনি রাশিদার। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে পড়েছেন মহাবিপদে।
গত মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা। ভেতরে একটি চৌকিতে মশারি টানিয়ে শুয়ে রয়েছেন জয়নাল ব্যাপারী। ভেতরে প্রবেশ করতেই ঝাপসা চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। স্ত্রী রাশিদার কথা জিজ্ঞেস করতেই জয়নাল ব্যাপারীর চোখে পানি চলে এল। সকাল থেকে না খাওয়া অসুস্থ বৃদ্ধ জয়নাল বললেন, ‘ঘরে রান্না করার কিছু নাই। রাশিদা বাজারে গেছে। আমি খুব অসুস্থ। উঠে দাঁড়াতে পারি না।’
এই দম্পতি যেখানে থাকেন, সেখান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে একটি ধানভাঙা মিলে রোজ ১০০ টাকা মজুরিতে এক বেলা কাজ করেন তিনি। ঘরে ফিরে রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমাগো চার শতক জমি ছিল। ৩০ বছর আগে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাতে সেই জমি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি কইরা দিই। পোলা-মাইয়াগো অভাবের সংসার। ছোট পোলা ঢাকায় প্রাইভেট কার চালায়। ঢাকায়ই থাহে। বড় পোলা কামলা দিয়া খায়। ওগের দিতে পারলে ভালো। আমরা বুড়া হইয়া গেছি। কিছু দিতে পারি না। তাই দুই পোলার ঘরে আর থাকতে পারি নাই। স্বামী সাত হাজার টাকা বেতনে একটি ব্যাটারির কারখানায় কাম করত। চার মাস ধইরা অসুস্থ হইয়া ঘরে পড়ার পরে সেই কামও আর করতে পারে না। তাই বাধ্য হইয়া আমি কামে গেছি। বুড়া মানুষ দেইখা মিলে কামে বেশি টাকাও দেয় না। তবু পেটের জ্বালায় কাম কইরা যা পাই, তা দিয়া চলি। আল্লায় আমাগো খুব কষ্ট দিছে। কেউ দেখে না, খুব কষ্টে আছি।’
এই অসহায় দম্পতির বিষয়ে যোগাযোগ করলে মাদারীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসহায় বৃদ্ধ ওই দম্পতির বিষয়টি আমাদের জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে ওই দম্পতিকে সহযোগিতা করা হবে। চিকিৎসার জন্য যদি তাঁদের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, তা–ও করা হবে।’