নোয়াখালীতে বন্যার পানি না নামার কারণে খামারের গরু নিয়ে খামারিরা পড়েছে বিপাকে। দেখা দিয়েছে গোখাদ্খাযের সংকট। সম্প্রতি বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রাম থেকে তোলা
নোয়াখালীতে বন্যার পানি না নামার কারণে খামারের গরু নিয়ে খামারিরা পড়েছে বিপাকে। দেখা দিয়েছে গোখাদ্খাযের সংকট। সম্প্রতি বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রাম থেকে তোলা

নোয়াখালী

বন্যায় পচে গেছে খড় ও ঘাস, খামারে খামারে হাড্ডিসার গরু

দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে নোয়াখালীর গরুর খামারগুলোতে দুধের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বন্যায় জেলার বেশির ভাগ এলাকায় গরুর খড়সহ গোখাদ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খামারিরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী গরুকে খাবার দিতে না পারার কারণে প্রতিদিনই দুধের উৎপাদন কমছে। কারও কারও উৎপাদন কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খামারে থাকা গরু নিয়ে তাঁরা বেশ বিপদের মধ্যেই আছেন। চোখের সামনে তরতাজা গরুগুলো খাবারের অভাবে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে দুধের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলার বাসিন্দাদের শরীরে আমিষ ও প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যায় জেলায় গরুর খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন, খাবারের অভাবে তাঁদের খামারে দুধের উৎপাদন কমে গেছে। একইভাবে মানুষজনের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুধের বিক্রিও কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে খামারিদের সরকারের সাধ্য অনুযায়ী গোখাদ্য সরবরাহ করাসহ পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

জেলার সদর উপজেলার ১৯ নম্বর চর মটুয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ জগতপুরের খামারি মো. কাউসার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর খামারে ছোট–বড় মিলিয়ে ১০টি গরু। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা বন্যার পানিতে ডুবে থাকার কারণে তাঁর খড়ের গাদার অর্ধেকের বেশি খড় পচে গেছে। একইভাবে বন্যার পানিতে ডুবে থাকার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে চাষ করা ঘাসও। এ পরিস্থিতিতে আগে দুই বেলায় যে খাবার খাওয়াতেন, তা এখন তিন বেলায় ভাগ করে খাওয়ান। এ কারণে দুধের উৎপাদন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। আগে তিনি দুধ পেতেন প্রতিদিন প্রায় ৩০ কেজি। এখন সেটা কমে পাচ্ছেন ১৬ থেকে ১৭ কেজি।

কাউসার হোসেন জানান, চাহিদা অনুযায়ী খাবার দিতে না পারায় গরুগুলো অনেক শুকিয়ে গেছে। গত কয়েক দিনে অনেক জায়গায় খোঁজ করেছেন, কোথায়ও গরুর খড় নেই। আগামী দু-তিন মাসেও কোথায়ও খড় পাওয়া যাবে না। খৈল, ভুসিসহ অন্যান্য খাদ্যের দামও বেড়ে চলছে। এ পরিস্থিতিতে এখন খামার টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব দূর করার আশায় খামারটি গড়েছেন। বন্যার কারণে এখন সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে।

একই উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের আরেক গরুর খামারি ইকবাল মাহমুদ ওরফে শাকিল বলেন, তাঁর খামারে গরুর সংখ্যা ছিল ১২। বন্যায় তাঁর তিনটি গরু মারা গেছে। এখনো দুটি গরু অসুস্থ। বাড়িতে গরুর যে খড় ছিল, বন্যায় সব পচে গেছে। ঘাসগুলোও পচে গেছে। এখন গরুর খাদ্যের তীব্র সংকট চলছে। ঠিকমতো খাবার দিতে না পারায় গরুগুলো হাড্ডিসার হয়ে গেছে। একের পর এক অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে শুধু বড় গরুর খামারিরাই নয়, বাড়িঘরে গরু লালনপালন করেন এমন ক্ষুদ্র খামারিরাও এখন গরুর খাবার নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। সেনবাগ উপজেলার কাদরা গ্রামের গৃহিণী বকুল বেগম বলেন, তিনটি গরু লালনপালন করেন তিনি। বন্যার পানিতে বাড়িতে থাকা খড় পচে গেছে। মাঠেও আগের মতো ঘাস পাওয়া যায় না। বন্যার পানিতে ডুবে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে খামারের গরু নিয়ে অনেক কষ্টে আছেন। ঠিকমতো গরুকে খাবার দিতে পারেন না।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার ভয়াবহ বন্যায় জেলার আটটি উপজেলার ৫ হাজার ৬৭টি গরুর খামার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বন্যার কারণে লাম্পিস্কিনসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত ১৬৭টি গরু, ৭৯টি মহিষ, ২০৯টি ছাগল, ৪৩৬টি ভেড়া, দুই লাখ ৯২ হাজার মুরগি ও ৪ হাজার ৯৮৫টি হাঁস মারা গেছে। সূত্র জানায়, বন্যার পানিতে গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে খামারগুলোতে দুধের উৎপাদন অনেক কমে গেছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় গরুর খাদ্যের সংকটের কারণে খামারিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রতিটি খামারে দুধের উৎপাদন কমে গেছে। আবার মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় দুধের চাহিদাও কিছুটা কমেছে। শহরের একটি বড় রেস্তোরাঁয় তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, আগে ওই রেস্তোরাঁ যে পরিমাণ দুধ প্রতিদিন সংগ্রহ করত, এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ‍দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে।

এই কর্মকর্তা জানান, সার্বিক পরিস্থিতিতে বন্যায় দুধের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমিষ ও প্রোটিনের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারিভাবে খামারিদের গোখাদ্য দিয়ে সহায়তাসহ পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অল্প কিছু গোখাদ্য তাঁরা পেয়েছেন, যা খামারিদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।