বেলজিয়াম উদ্ভাবিত কারাহ মডেল নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
বাংলাদেশে আলু চাষে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লেট ব্লাইট (নাবি ধসা) রোগ। প্রতিবছর আলুখেতে নাবি ধসা রোগের কারণে কৃষকেরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ‘কারাহ মডেল’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
গবেষণার এই মডেলের কার্যকারিতা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, যা দেশের আলু চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। ২০২৩ সালে দেশে মোট আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টন। শুধু খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, উচ্চমানের শ্বেতসার, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম এবং আঁশের চমৎকার উৎস আলু। তবে নাবি ধসা রোগ আলুচাষিদের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলুর এই রোগ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফসল ব্যাপকভাবে নষ্ট করে।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময়ে সঠিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগের ফলে আলুর মড়ক রোগ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম, গবেষক
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর নাবি ধসা রোগের কারণে দেশে উৎপাদিত আলুর ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। আলু চাষের এই ক্ষতি কমাতেই কাজ শুরু করেন অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক।
গবেষণা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ব্লাইট নেটওয়ার্কের এক আলোচনা সভায় অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বেলজিয়ামে উদ্ভাবিত কারাহ মডেলের সঙ্গে পরিচিত হন। এটি মূলত আবহাওয়ানির্ভর একটি পূর্বাভাস পদ্ধতি, যা একটি আবহাওয়া স্টেশনের মাধ্যমে নাবি ধসা রোগপ্রতিরোধে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণ করে। চীনের উচ্চ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বেইজিং হুইসি জুন্ডা টেকনোলজি কোম্পানি কারাহ মডেলটির জন্য অত্যাধুনিক এইচএসজেডি স্টেশন নকশা ও নির্মাণ করে। ছোট এই স্টেশন জমির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার মতো তথ্য সংগ্রহ করে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষককে পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা দেয়। ওই মডেল অনুসারে ২০২৩ সালে অ্যাপেক্স অ্যাগ্রিসায়েন্স লিমিটেডের অর্থায়নে গোবিন্দগঞ্জে একটি এইচএসজেডি স্টেশন স্থাপন করে গবেষণা শুরু করেন রসিদুল ইসলাম।
গত জুন মাসে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড পটেটো কংগ্রেসে রসিদুল ইসলাম বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কারাহ মডেলের গ্রহণযোগ্যতাবিষয়ক গবেষণার একটি সেমিনার পেপার উপস্থাপন করেন। গবেষণা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, গবেষণার প্রাথমিক সাফল্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ১৮০টি আবহাওয়া স্টেশন স্থাপনের জন্য চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (সিআইডিসিএ) কর্তৃক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের একটি প্রকল্প সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। এই স্টেশনগুলো কারাহ মডেলের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং আলু উৎপাদনে সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক সময়ে সঠিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগের ফলে আলুর মড়ক রোগ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে এসেছে এবং লাভ বেড়েছে।’
বাংলাদেশে আলুখেতে মড়ক দমনে কৃষকেরা সাধারণত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। গবেষকেরা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় ছত্রাকনাশক প্রয়োগের অভাবে একদিকে খরচ যেমন বেড়ে যায়, অন্যদিকে মাটির স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা সমাধানে কারাহ মডেল হতে পারে একটি কার্যকর ও সাশ্রয়ী সমাধান। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মডেল ব্যবহার করে মাত্র ৬ বার ছত্রাকনাশক প্রয়োগের মাধ্যমেই নাবি ধসা রোগ দমন করা সম্ভব, যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ১২ থেকে ১৬ বার ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কারা মডেলে দেখা গেছে, রোগমুক্ত বীজ আলু উৎপাদন নিশ্চিত হয়েছে, উৎপাদন খরচ কমেছে এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি উৎপাদন পাওয়া গেছে।
গবেষণা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি এইচএসজেডি স্টেশনের দাম প্রায় ৪ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা) এবং এটি ৩১৫ হেক্টর জমির তথ্য পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জমির অবস্থা সম্পর্কে সতর্কবার্তা কৃষকদের কাছে পৌঁছে যায়, যা তাঁদের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
অধ্যাপক মো. রসিদুল ইসলাম জানান, কারাহ মডেল ইতিমধ্যে চীন ও বেলজিয়ামে সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনে এটি বর্তমানে মড়ক দমনে ন্যাশনাল রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এটি টেকসই কৃষিপ্রযুক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষক দলটির পরিকল্পনা রয়েছে, দেশের ১৫টি আলু উৎপাদনকারী জেলায় দুই থেকে তিনটি করে আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন করার। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে জৈবিক ছত্রাকনাশকের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ চলছে।