শুধু এসএসসি পর্যন্ত না, আমি আরও পড়তে চাই

রাজশাহীর আলোর পাঠশালার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন খাতুনের বয়স ১৩ বছর। মায়ের পেটে থাকতেই বাবা ছেড়ে চলে যান মাকে। জেসমিনের মা একজন গৃহকর্মী। সে তার মায়ের একমাত্র সন্তান। ১০ মার্চ মা তার বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। গায়েহলুদ হয়েছিল। হয়েছিল ক্ষীরের অনুষ্ঠানও। এই অবস্থায় শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা বলে বিয়ের আসর থেকে উঠে যায় জেসমিন। পরে শিক্ষকদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে নিজেই নিজের বাল্যবিবাহ বন্ধ করে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

প্রশ্ন

বুদ্ধি করে নিজের বিয়ে ঠেকিয়েছ। কেমন লাগছে?

জেসমিন খাতুন: ভালো লাগছে। কারণ, আমি এখন লেখাপড়াটা শেষ করতে পারব। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব।

প্রশ্ন

স্কুলের শিক্ষকদের কাছে যাওয়ার কথা মনে হলো কেন?

জেসমিন খাতুন: শিক্ষকেরা সব সময় আমাদের বলেন যে বাল্যবিবাহ করা যাবে না। তাই ভাবলাম, তাঁদের কাছে গিয়ে বললে তাঁরা সাহায্য করবেন।

প্রশ্ন

কত দিন ধরে বাড়িতে বিয়ের কথা আলোচনা হচ্ছিল?

জেসমিন খাতুন: এক সপ্তাহ আগে থেকে বাড়িতে বিয়ের আলোচনা হচ্ছিল।

প্রশ্ন

নিজের মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলে?

জেসমিন খাতুন: চেষ্টা করেছিলাম। তখন মা বলেছিলেন, বিয়ে হলেও ওরা এসএসসি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ দেবে।

প্রশ্ন

তখন তুমি কী বলেছিলে?

জেসমিন খাতুন: আমার মনে হয়েছিল, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পড়াশোনা করতে না–ও দিতে পারে। আমার এক বান্ধবীর এভাবেই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়েছিল। এরপর সে সন্তানের মা হয়। আর সে পড়তে পারেনি। আর আমি তো শুধু এসএসসি পর্যন্তই পড়তে চাই না। আমি শেষ পর্যন্ত পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে চাই।

প্রশ্ন

আগের দিন গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে। তোমাকে ক্ষীর খাওয়ানো হয়েছে, তখন আপত্তি করোনি কেন?

জেসমিন খাতুন: আমার মায়ের হার্টের অসুখ আছে। আপত্তি করলে মা টেনশন করবেন। মা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এই ভয়ে চুপ ছিলাম।

প্রশ্ন

বিয়ে ঠেকানোর জন্য আর কোনো কৌশল অবলম্বন করেছিলে?

জেসমিন খাতুন: হ্যাঁ, মাকে বোঝানোর পরও যখন মানেননি, তখন ঘরে দরজা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তোমরা সুখে থাকো। আমি দুনিয়ায় থাকব না। তখন মা বুঝেছিলেন। পরে আবার দেখছি, যা তা–ই।

প্রশ্ন

বিয়ের আসর থেকে স্কুলে চলে যাওয়ার পর মাকে হাসপাতালে নেওয়ার খবর শুনে তোমার কী মনে হয়েছিল?

জেসমিন খাতুন: প্রথমে মনে করেছিলাম, সত্যিই মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন মনে হয়েছিল, মা যদি না থাকেন, তাহলে আমি দাঁড়াব কোথায়। এই ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, মা বাড়িতে রয়েছেন। ঘটনাটি তেমন নয়। তখন আমি আরও শক্ত হয়েছি।

প্রশ্ন

স্কুলের শিক্ষকদের আসার খবর পেয়ে বরযাত্রীকে ঘরে লুকিয়ে রাখার বিষয়টি তুমি কীভাবে জানতে পেরেছিলে?

জেসমিন খাতুন: স্যারদের বসতে দেওয়ার জন্য আমি পাশের বাড়ির একটি ঘরে চেয়ার আনতে গিয়ে দেখি ঘরে বরপক্ষের লোকজন বসে আছে। স্যারদের কাছে মা যখন বললেন যে বরপক্ষের লোকজন চলে গেছে, তখন আমি এই ঘটনা ফাঁস করে দিয়েছি।

প্রশ্ন

তখন তোমার মা কী বললেন?

জেসমিন খাতুন: মা বললেন, আমার মেয়েই যখন আমার মুখ রাখছে না, তখন আমি আর মেয়ের বিয়ে দেব না। তবে আমার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব স্কুলের ম্যাডামকে নিতে হবে। ম্যাডাম যখন দায়িত্ব নিতে চাইলেন, তখন মা আর কোনো কথা বলতে পারেননি।

প্রশ্ন

পরে বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়নি?

জেসমিন খাতুন: ঝামেলা হয়নি; কারণ, ম্যাডাম মহিলা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে জানিয়েছিলেন। তিনি এসে মায়ের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা সই করে নিয়ে গেছেন। মা তাঁর কাছে ওয়াদা করেছেন যে বিয়ের বয়স না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমার বিয়ে দেবেন না।