ছয় বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল

তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় বাবা-মায়ের খুনের বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী নিহত দম্পতির বড় ছেলে সুজিত কুমার সাহা।

অরুণ কুমার সাহা, হেনা রানী সাহা

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে শোবার ঘরে ব্যবসায়ী অরুণ কুমার সাহা ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী সাহাকে গলা কেটে হত্যার পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এ মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে ছয় বার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অভিযোগ, দুর্গাপুর থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল ইসলাম খান (বর্তমানে জামালপুরে কর্মরত) ঘটনার পর আলামত সংগ্রহ করেননি। এ ব্যাপারে গতকাল রেজাউল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল ধরেননি।

মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ময়মনসিংহ কার্যালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর প্রয়োজনীয় আলামত সংরক্ষণ না করায় মামলাটি তদন্ত করতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। ডাকাতিসহ সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চালানো হচ্ছে।

তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় বাবা–মায়ের খুনের বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী নিহত দম্পতির বড় ছেলে সুজিত কুমার সাহা। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা-মাকে তো আর কখনো ফিরে পাব না। কিন্তু আমি চাই, এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হোক। বারবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হচ্ছে। যে–ই তদন্তে আসেন, বলেন, আরও সময় লাগবে। প্রায় এক বছর ধরে তদন্ত কর্মকর্তাও আর যোগাযোগ রাখেন না। বিষয়টি নিয়ে এখন হতাশ হয়ে পড়েছি।’

পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার শেষ দিন (বিজয়া দশমী) ভোর থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে নিজ বাসার তিনতলার শোবার ঘরে খুন হন ব্যবসায়ী অরুণ কুমার (৭৪) ও তাঁর স্ত্রী হেনা রানী (৬৫। এরপর ২৬ অক্টোবর সুজিত কুমার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে দুর্গাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর দুর্গাপুর থানা-পুলিশের কাছ থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। সিআইডি দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। সিআইডির সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন নেত্রকোনার তখনকার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার শংকর কুমার দাস। ওই সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এক বছর পর তাঁকে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। ততদিনে গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সন্দেহভাজন কয়েকজনের মুঠোফোনের কল রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। কোনো কিছুই সংরক্ষণ করা হয়নি। অন্ধকারের মধ্যে তদন্ত করতে হচ্ছে।

২০১৭ সালের শেষ দিকে আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন শংকর কুমার দাস। পরে মামলার বাদী নারাজি আবেদন করলে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত শুনানি শেষে মামলাটি আবার তদন্তের জন্য ময়মনসিংহ পিবিআইকে দায়িত্ব দেন। ওই কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. আবুল কাশেমের তদন্তের পর ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান নেত্রকোনায় পিবিআইয়ের কার্যালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ জাকির হোসেন।

মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি পিবিআই প্রধানের সঙ্গে কথা বলব। আশা করছি, এ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে পুলিশ।’

নিহত অরুণ কুমার সাহা দুর্গাপুর পৌরশহরের মধ্যবাজার এলাকায় ‘সুবর্ণা প্লাজা’ নামের তিনতলা মার্কেটের ও সেখানকার সুবর্ণা বস্ত্রালয়ের মালিক ছিলেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা প্লাজার তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট ছেলে সুদীপ কুমার সাহা ও মেয়ে সুলেখা সাহা ইতালিতে এবং বড় মেয়ে সুবর্ণা সাহা কানাডায় থাকেন। বড় ছেলে সুজিত কুমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। সুজিতের স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন।

ঘটনার দিন পারিবারিক কাজে ঢাকায় ছিলেন জানিয়ে সুজিত কুমার প্রথম আলোকে বলেন, পরদিন সকাল ১০টার দিকে মা-বাবার খোঁজ নিতে মুঠোফোনে তিনি কল করেন। না পেয়ে দুপুরে পাশের বাসায় চাচা অজিত কুমারকে ফোন করে মা–বাবার খোঁজ নিতে বলেন। অজিত কুমারের স্ত্রী সুচিত্রা তৃতীয় তলায় অরুণের বাসার দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে দেখেন, দুটি কক্ষের মেঝেতে গলাকাটা অবস্থায় অরুণ ও হেনার লাশ পড়ে আছে।