সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী জলজ খাদ্যশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অন্যান্য প্রজাতির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তিমি ও ডলফিনের মতো স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় এগুলো একের পর এক মারা পড়ছে। ডলফিন ও তিমির মৃতদেহ ভেসে আসছে উপকূলের বালিয়াড়িতে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মৃত শুশুক এবং সোমবার প্রায় ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মৃত তিমি ভেসে আসে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। এতে হুমকিতে পড়ছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র।
উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও সমুদ্রের নীল অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকো ফিশ বাংলাদেশ-২ অ্যাকটিভিটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে কেবল কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেই ১৭টি মৃত ডলফিন ও ৩টি তিমির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ২০২০ সালে ১৮টি এবং ২০২১ সালে ২৪টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছিল এ সৈকতে।
এ ছাড়া কক্সবাজার সৈকতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৬টি ডলফিন ও দুটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। এ ছাড়া গত বছরের ২৮ আগস্ট কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে আড়াই টন ওজনের একটি মৃত নীল তিমি ভেসে আসে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান ও ডলফিন গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সুন্দরবনসংলগ্ন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড থেকে সোনারচর পর্যন্ত ইরাবতী ডলফিনের বিরাট দল ঘোরাফেরা করে। এদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধানে আমরা কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, তিনটি কারণে ডলফিন মারা যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, সাগরের ১২০ ফুট গভীরতায় ট্রলিংয়ের মাধ্যমে মাছ শিকার, জেলেদের জালে আটকা পড়ার পর পিটিয়ে হত্যা এবং দূষণ।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিমি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীরা জলজ খাদ্যশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অন্যান্য প্রজাতির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যত বেশি তিমি ও ডলফিন মারা যায়, তত বেশি সমুদ্রের খাদ্যশৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটাসিয়ান প্রজাতির প্রাণী যেমন তিমি, ডলফিন ও শুশুক বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ভারসাম্যকে স্থির রাখতেও খুব ভূমিকা রাখে। এমনকি যে নদীতে ডলফিন থাকে, সেই নদীতে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং নদীর পরিবেশ সুস্থ থাকে। এদের উপস্থিতি পানির গুণগত মান বা অবস্থা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখতেও এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন একটি প্রাপ্তবয়স্ক ডলফিনের ৩০ কেজি পর্যন্ত খাবার প্রয়োজন। এরা নদীর ছোট, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। ডলফিন না থাকলে মাছের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, ফলে মাছের মধ্যে খাদ্য গ্রহণের প্রচুর প্রতিযোগিতা হয় এবং খাদ্যসংকট দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরাবতী ডলফিনের প্রজাতি বিশ্ব থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে টিকে আছে মাত্র সাত হাজার। যেগুলোর প্রায় ৫ হাজার ৮০০টিই বাংলাদেশে। বিশ্বজুড়ে বিপন্ন হয়ে পড়া ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এর কারণ, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোতে রয়েছে নোনা ও মিঠাপানির অনুকূল ভারসাম্য।
বন বিভাগ জানায়, ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের তিনটি নদীর ৪৭ কিলোমিটার নৌপথকে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উত্তর প্রান্ত ঘিরে ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ডলফিন, তিমি, কচ্ছপ, হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ সংরক্ষণের জন্য সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা (এমপিএ) ঘোষণা করে।
ডলফিনের আবাসস্থল রক্ষায় আগাম উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাংলাদেশ সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ‘গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য রক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ’ (ইপিএএসআইএই) নামে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সুন্দরবনের ডলফিনের জন্য সংরক্ষিত এলাকা রক্ষা।
প্রকল্পটির গবেষক দলের বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগেও পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর ও সুন্দরবন সন্নিহিত নদ-নদীর উজানে প্রচুর ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিনের বিচরণ ছিল। কিন্তু এখন সেটা অনেক কম।
অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, ‘ইরাবতী ডলফিনের এত মৃত্যু খুবই ভয়াবহ বার্তা। মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখেছি, অনেক ডলফিন জালে আটকা পড়ে মারা পড়েছে। কিন্তু এখন সেটা আশঙ্কার পর্যায়ে। এ জন্য এখনই সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
সরকারিভাবে দেশে ৯টি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সুন্দরবনের তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্যের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে ডলফিন হত্যার জন্য সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েেছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ কিংবা হত্যা রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের ঢাকার আগারগাঁও প্রধান কার্যালয়ের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বাস্তবায়নে বিদ্যমান আইনে কিছু দুর্বলতা আছে, সেগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই আইন প্রয়োগে আমাদের জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে। এ নিয়ে কাজ করছি।’