ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলিতে ব্যস্ত দুই তরুণ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরের তারাগঞ্জের ইকরচালী ঈদগাহ মাঠে
ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলিতে ব্যস্ত দুই তরুণ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রংপুরের তারাগঞ্জের ইকরচালী ঈদগাহ মাঠে

‘গ্রামে রাস্তায় যে–ই দেখা পাচ্ছে, সে–ই টেনে নিয়ে সেমাই খাওয়ায়’

গ্রামের ঈদ মানে উৎসব-আনন্দের কমতি নেই। শিশু-কিশোর, তরুণ-বৃদ্ধ—সব বয়সী মানুষের আনন্দ-আহ্লাদের দিন। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার গ্রামগুলোতে ঘরে ঘরে ঈদ উৎসবের শুরু হয় ভোর থেকে। ভোরের আলো ফুটতেই মানুষ স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে বেরিয়ে পড়েন। নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেমাই, মাংস, পোলাও রান্নায়। নামাজ শেষে চলে কুশল বিনিময়, ঘোরাঘুরিসহ নানা আয়োজন।

প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদ উৎসবের আমেজ বইছে তারাগঞ্জের মানুষের মধ্যে। ১০ বছর জীবিকার তাগিদে ঢাকায় পাড়ি জমান তারাগঞ্জের মেনানগর গ্রামের লাইলী বেগম ও সহিদার রহমান দম্পতি। এক দশক পর গ্রামে ফিরেছেন দুই সন্তান নিয়ে। ঈদের নামাজ শেষে গ্রাম, ফসল মাঠ দেখতে সন্তানদের নিয়ে বেরিয়েছেন। ঈদ কেমন যাচ্ছে, জানতে চাইলে সহিদার রহমান বলেন, ‘ঢাকার জীবন যান্ত্রিক। ১০ বছর সেখানে ঈদ করেছি, সেগুলো ছিল নিষ্প্রাণ। কেউ কাউকে চেনে না, কারও কাছে যায় না। অথচ গ্রামে ভোর থেকে ঈদের আমেজ শুরু হয়। তাই এবার দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামে ঈদ করতে এসেছি। বহুদিন পর গ্রামে এসে আসল ঈদের স্বাদ পেলাম। প্রতিবেশী, স্বজন, বন্ধুদের আতিথেয়তা পেলাম।’

প্রতিবছরই ঈদের আগে গ্রামে আসেন ডাঙ্গাপাড়ার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম। ঈদের দিন কেমন যাচ্ছে, জানতে চাইলে হাফিজুল ইসলাম বলেন, ভোরের আধঘুমে মা ডেকে তুলে গোসলের পানি দিয়েছেন। গোসল করে কবর জিয়ারত করেছেন। বাড়িতে ফিরে মায়ের হাতের সেমাই খেয়ে নামাজ আদায় করেছেন। নামাজ শেষে বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঘরে ফিরেছেন। তারপর পরিবারে সবার সঙ্গে পোলাও-মাংস খেয়ে বাইরে বের হয়েছেন।

হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামে রাস্তায় যে-ই দেখা পাচ্ছে, সে-ই টেনে নিয়ে সেমাই খাওয়ায়। এর থেকে আনন্দের আর কী আছে। বিকেলে সবুজ-শ্যামলে ফসলে ভরা গ্রাম আর মাঠঘাট ঘুরে দেখব ভাবছি। বহুদিন প্রকৃতি দেখা হয় না।’

নামাজ শেষে নাতি-নাতনিদের নিয়ে মেলায় যাচ্ছিলেন ইকরচালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ফজলার রহমান। কথা হলে তিনি বলেন, ‘ঈদ এলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমি শিশু হয়ে যাই। ছোটবেলায় ঈদের দিন বৃষ্টি হলে খড়ের ঘরের চাল বেয়ে লালচে পানি পড়ত। সেই পানির স্রোতে নতুন কাপড় পড়ে কাগজের নৌকা ভাসাতাম। কাদামাটিতে লুটোপুটি খেলতাম। মেলায় যেতাম, কত স্মৃতি যে মনে পড়ে। তাই নামাজ শেষে নাতিদের নিয়ে মেলার দিকে যাচ্ছি। ঈদের আনন্দ আমার নাতি-নাতনিদের ঘিরেই।’

উৎসবের মধ্যেও থেমে নেই গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ততা। বেলা দুইটায় সড়কের ধারে গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন হাজীপাড়া গ্রামের রাহেনা বেগম ও বগা মিয়া দম্পতি। রাহেনা বেগম বলেন, ‘বুড়া হইছি, হামার আর ঈদ আছে। সকালে সেমাই, ভাত রান্না করছি। স্বামী, সন্তান, নাতনিকে নিয়া খাইছি। ঈদ দেখিয়া তো ঘরোত বসি থাকলে হবার নয়। ঘরোত গরুর খাবার নাই। ওই জন্যে সড়কোত গরুক ঘাস খাওয়ার নিয়া যাচ্ছি।’

ইকরচালী বাজারে একদল তরুণের জটলা দেখা যায়। সেখানে কথা হয় মোহাম্মদ আলী নামের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি জানান, ঈদ করতে বাইরে থেকে যাঁরা গ্রামে আসেন, তাঁদের নিয়ে প্রতিবছর গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। বিবাহিতরা একদল আর অবিবাহিতরা আরেক দল। এই দুই দল মিলে খেলা হয়। খেলা ঘিরে থাকেন হাজারো উৎসুক দর্শক। এবারের ঈদেও এমন আয়োজন করবেন, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।