বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ হোসেন (২২) যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, সেদিন সকালেও স্বজনদের সঙ্গে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলাপ করেছিলেন। বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে বড় ভাইকে বলেছিলেন, ‘ভাই, চলেন শহীদ হয়ে আসি।’ গত ৪ আগস্ট মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ওই তরুণ।
ফরহাদ হোসেন শ্রীপুর উপজেলার রায়নগর গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরিবারে চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। তাঁর বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। বড় দুই বোন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। তাঁদের বাবা গোলাম মোস্তফা বেসরকারি একটি কোম্পানিতে গাড়িচালকের চাকরি করেন।
ফরহাদের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে ছোট হলেও ম্যাচিউরিটি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করত। এ কারণে কেউ তাকে আটকাতে পারেনি। ঘটনার দিন সকালে আমাকে বলল, ভাই, চলেন শহীদ হয়ে আসি।’
ফরহাদ বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছে শান্ত, বিনয়ী ও দায়িত্বশীল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। ফরহাদের সঙ্গে একই কক্ষে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। প্রচুর পড়ালেখা করত। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার সময় ডিপার্টমেন্টে দ্বিতীয় হয়। ওর বন্ধুরা ওর কাছে সাজেশন নিতে আসত। ওকে দেখে আমার হিংসা হতো।’ তিনি আরও বলেন, হল বন্ধ ঘোষণার আগে চট্টগ্রামে তাঁরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন।
শ্রীপুরের রায়নগর থেকে মাগুরা শহরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। ঘটনার দিন রায়নগর থেকে একটি ইজিবাইকে করে সাতজন কয়েক দফা বাধা পেরিয়ে পারনান্দুয়ালী এলাকায় আসেন। তাঁদের মধ্যে ফরহাদের স্কুলের বন্ধু রায়নগর গ্রামের বাসিন্দা ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমরা ১১টার দিকে পারনান্দুয়ালী এলাকায় পৌঁছাই। মহাসড়কে আগুন আর মারামারি দেখে ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু ফরহাদের মধ্যে ভয় কাজ করছিল না। বেলা দুইটার দিকে আন্দোলনের একেবারে সামনে চলে যাই। তখন বিপরীত দিক থেকে আমাদের ধাওয়া দিলে পেছনে ফিরে আসি। তখন বিপরীত থেকে একটি বুলেট এসে ফরহাদের মাথায় লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে একটি নছিমনে করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
ময়নাতদন্ত ছাড়াই ফরহাদকে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর পরিবার কোনো মামলা করেনি। তবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২১ আগস্ট সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন সদর উপজেলার বিরপুর গ্রামের মো. জামাল হোসেন। মামলায় মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান, মাগুরা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারসহ ৬৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন তাঁর সামনেই আসামিদের ছোড়া গুলিতে ফরহাদ নিহত হয়েছেন।
মামলার বাদী জামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সামনেই ফরহাদ নিহত হন। তখন আমাদের আরও অনেক ছেলে আহত হন। এখনো তাঁদের নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করছি। বিষয়টি নিয়ে ফরহাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা মামলা করতে রাজি হননি। এরপর আমি মামলা করি।’
মামলা না করার বিষয়ে ফরহাদের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা মামলা করিনি। কারণ, আমরা চাই না আমার ভাইয়ের লাশ আবার কবর থেকে উত্তোলন করা হোক। তবে আমরা ন্যায়বিচার চাই। ঘটনা ঘটেছে দিনের আলোতে। অনেক চাক্ষুষ সাক্ষী আছে। আশা করি, আমরা ন্যায়বিচার পাব।’
মাগুরায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সংঘর্ষে ফরহাদ হোসেনসহ চারজন নিহত হন। সবাই ৪ আগস্ট মারা যান। নিহত অন্য তিনজন হলেন মাগুরা পৌরসভার বরুনাতৈল গ্রামের মেহেদী হাসান রাব্বি (৩৪), মহম্মদপুর উপজেলা সদরের ব্যাপারী পাড়ার আহাদ আলী বিশ্বাস (১৭) ও একই উপজেলার বালিদিয়া গ্রামের সুমন শেখ (১৮)। এর মধ্যে মেহেদী পারনান্দুয়ালী এলাকায় নিহত হন। তিনি মাগুরা জেলা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর আহাদ ও সুমন মহম্মদপুরে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।